রবিবার | ১৬ নভেম্বর | ২০২৫

হামাসের সাথে মধ্যস্থতায় তুরস্ককে পাশে চায় ফাতাহ

ঐক্যবদ্ধ হতে চাচ্ছে ফিলিস্তিনের বিবাদমান প্রধান দুইটি শক্তি হামাস ও ফাতাহ। নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগানের দারস্ত হয়েছে সংগঠন দুইটি।

ফিলিস্তিনের দুই অংশের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে দুইটি বড় দল। একটি ইয়াসির আরাফাতের জাতীয়তাবাদপন্থী ফাতাহ ও অন্যটি শায়েখ আহমাদ ইয়াসিন প্রতিষ্ঠিত ইসলামপন্থী হামাস।

পশ্চিম তীর কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ফাতাহ। বর্তমানে ফাতাহের নেতৃত্বে রয়েছেন মাহমুদ আব্বাস। তিনি একই সাথে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করছেন।

অন্যদিকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্বাধীনতাকামীদের নেতৃত্ব দেওয়া দল হামাস নিয়ন্ত্রণ করে গাজ্জা অঞ্চল। হামাসের বর্তমান প্রধান ইসমাইল হানিয়া একসময় ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন।

ফিলিস্তিনের প্রধান এই দুইটি পক্ষ বহুকাল ধরে বিরোধের মধ্যে রয়েছে। তবে এবার দুই পক্ষই চাচ্ছেন নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে। এই লক্ষে তুরস্ক সফর করেছিলেন ফাতাহ প্রধান মাহমুদ আব্বাস ও হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া। এরদোগানের মদ্ধস্ততায় বৈঠকও করেছিলেন এই দুই নেতা। পরবর্তিতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ঐক্য পক্রিয়া কিছুটা কিছুটা ধীরগতিতে এগুচ্ছিলো।


সম্প্রতি ঐক্য পক্রিয়া এগিয়ে নিতে তুরস্ক সফরে যান ফাতাহের মহাসচিব জিব্রিল রাজুব। সফরকালে তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ বিভক্তি দূর করে জাতীয় ঐক্য গড়তে হামাসের সাথে মধ্যস্থতায় তুরস্ককে পাশে চাই আমরা। কেননা তুরস্ক মুসলিম দেশ হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ও অত্র অঞ্চলের বৃহৎ একটি রাষ্ট্র। হামাস-ফাতাহর বিভক্তির অবসান এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠায় তারা প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে।

ফাতাহ মহাসচিব আরও বলেন, আমরা হামাসকে ফিলিস্তিনি সমাজেরই এক অপরিহার্য অংশ বলে মনে করি। ৭ অক্টোবর থেকে কাসসাম বিগ্রেডের শুরু করা যুদ্ধকে সন্ত্রাসী নয় বরং বীরোচিত প্রতিরোধ যুদ্ধ বলে ফাতাহ বিবেচনা করে।

এছাড়াও তিনি ফিলিস্তিনিদের জন্য ১৯৬৭ এর সীমানা অনুযায়ী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।ফাতাহ মহাসচিব বলেন, ইসরাইলের সাথে সংঘাতের সমাধানে জাতীয় ঐক্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হয়ে উঠবে।

তিনি বলেন, প্রতিরোধ যুদ্ধকে সফল করতে ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সংকট থেকে উত্তরণে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এর ফলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, জাতিসংঘ এবং সমগ্র বিশ্বে ফিলিস্তিনিদের বার্তা জোরালো হবে। আর এধরণের অর্জন জাতীয় ঐক্য ছাড়া সম্ভব নয়। আমরা চাই, এমন ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিন গড়তে যা হয়ে উঠবে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও বিশ্ব শান্তির আস্থার স্থল। আমরা চাই, হামাসের ভাইয়েরাও এই লক্ষ্য পূরণে একসাথে কাজ করুক।


ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ও ফাতাহ-এর মধ্যকার বিরোধ দীর্ঘদিনের। দল দুটির মধ্যে চলমান বিরোধ কেবল ক্ষমতা কেন্দ্রিক নয়, বরং তা আদর্শিক ও দৃষ্টিভঙ্গিগত।

প্রথম ইন্তিফাদার পর ১৯৮৭ সালে শায়েখ আহমাদ ইয়াসিন প্রতিষ্ঠা করেন হারাকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া বা হামাস। শুরু থেকেই হামাসের আদর্শ ইসলাম কেন্দ্রিক। একই সাথে তারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বদ্ধপরিকর।

অন্যদিকে ইয়াসির আরাফাতের দল ফাতাহ শুরু থেকেই সেকুলার ও জাতীয়তাবাদী। এতে করে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের কারনে শুরু থেকেই দল দুটির মধ্যে বিরোধ চলে আসছিলো।

তবে বিরোধ চূড়ান্ত রুপ নেয় ১৯৯৩ সালে ‘অসলো চুক্তির পর। এর কারণ হামাসসহ বেশিরভাগ ফিলিস্তিনিদের মতামতকে উপেক্ষা করে ফাতাহ প্রধান ও তৎকালীন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিনের সাথে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির মধ্যদিয়ে বিজয়ের অনেকটা দারপ্রান্তে থাকা ইসরাইল বিরোধী সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামেও ভাটা পড়ে।

অসলো চুক্তির মাধ্যমে পুরো ফিলিস্তিনের হয়ে ইয়াসির আরাফাত ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দেন। বিনিময়ে ইসরাইলও এই চুক্তির আওতায় ফিলিস্তিনের বৈধ ও একমাত্র প্রশাসক হিসেবে ফাতাহকে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের পুরো বিষয়টিতে হামাসসহ ফিলিস্তিনের বৃহৎ অংশকে অগ্রাহ্য করা হয়।

এই চুক্তির মাধ্যমে ইয়াসির আরাফাত মূলত ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে চলা সশস্ত্র সংগ্রামের ইতি টেনেছিলেন। ইয়াসির আরাফাতের এমন কাণ্ডে মার্কিন-ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড সাইদ থেকে শুরু করে উপনিবেশবাদবিরোধী সব চিন্তক ও বিল্পবীরাও হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এডওয়ার্ড সাইদ আরাফাতের এই চুক্তিকে শান্তি প্রতিষ্ঠা নয় বরং নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ ও ফিলিস্তিনিদের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।

ইয়াসির আরাফাতের এমন কাণ্ডে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের মাঝেও ইসলাম পন্থা ও জাতীয়তাবাদের মিশ্রণে গড়ে উঠা ফাতাহর প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। পশ্চিমা উপনিবেশ ও ইসরাইল প্রশ্নে আপোষহীন ও ইসলাম পন্থায় অটল থাকায় ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে হামাসের জনপ্রিয়তা।

২০০০ সালের দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় হামাস ও শায়েখ আহমাদ ইয়াসিনের জনপ্রিয়তা আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এর প্রভাব পড়ে ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত ফিলিস্তিনের সাধারণ নির্বাচনে। সেই নির্বাচনে ১৩২ আসনের মধ্যে হামাস ৭৬টি এবং ফাতাহ ৪৩টি আসন পায়। নির্বাচনে ফাতাহর পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল, পশ্চিমাদের প্ররোচনায় ইসরাইলের সঙ্গে আপোষ এবং ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামকে বিকিয়ে দেওয়া।

নির্বাচনে জিতে হামাস ফিলিস্তিনে সরকার গঠন করে। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া। কিন্তু মাত্র এক বছরের মাথায় হামাসের সরকারকে বরখাস্ত করেন ফাতাহর প্রধান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস।

হামাস সরকার গঠনের পর আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়। বিষয়টিকে জাতীয় সংকট হিসেবে সামনে এনে মাহমুদ আব্বাসকে হামাসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে বরখাস্ত করতে বাধ্য করেন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিজা রাইস।

পরবর্তীতে ২০০৭ সালে ফাতাহ সমর্থিত বাহিনী ও ইসরাইলী সেনাদের পরাজিত করে গাজ্জা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেখানে সরকার গঠন করে হামাস। এই ঘটনায় ইসরাইলও নড়েচড়ে বসে এবং উপত্যকাটিকে সর্বাত্মক অবরোধের আওতায় নিয়ে আসে। সেই থেকে পুরো ফিলিস্তিন কার্যত ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পশ্চিম তীর শাসন করতে থাকে ফাতাহের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার। অন্যদিকে হামাস সরকার নিয়ন্ত্রণে চলে যায় গাজ্জা।

ইসলামপন্থী হওয়ায় শুরু থেকেই হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছে আমেরিকা ও তার মিত্ররা। পশ্চিমারা হামাসকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিনিময়ে তাদের সামরিক শাখাকে বিলুপ্ত করার শর্ত দিয়ে দিয়ে আসছে বহুবছর ধরে। তবে হামাস এই শর্ত মানবে না বলে বারবার জানিয়ে দিয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে গাজ্জার পাশপাশি পশ্চিম তীরেও হামাসের জনপ্রিয়তা বেড়েছে বহুগুণ। এতে করে চাপে রয়েছে ফাতাহ। তাই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফাতাহ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে হামাসের সাথে ঐক্য গড়তে। এজন্য তারা বেছে নিয়েছে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্র তুরস্ককে। বিশেষ করে দেশটির প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানকে ফাতাহ ও হামাস দুই পক্ষই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এরদোগানের মদ্ধস্ততায় একাধিকবার আলোচনার টেবিলে বসেছেন হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া ও ফাতাহ প্রধান মাহমুদ আব্বাস। তাই ধারণা করা হচ্ছে অচিরেই সংগঠন দুটির মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠবে।

সূত্র: মিডল ইস্ট মনিটর

spot_img

সর্বশেষ

spot_img

এই বিভাগের

spot_img