সুদানে যার যার অবস্থান থেকে পালিয়েছে ইহুদিবাদী সন্ত্রাসীদের অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল ও তাদের মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত সমর্থিত আরএসএফ বাহিনী।
বুধবার (২৬ মার্চ) আব্দুল ফাত্তাহ আল বুরহানের বাহিনী রাজধানী খুরতুম ও প্রেসিডেন্ট ভবন দখলে নেওয়ার পর আরএসএফ বাহিনীর পালানোর ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয়।
ভিডিওতে দেখা যায়, আরএসএফের শত শত সদস্য দক্ষিণ খুরতুমের জাবালে আউলিয়া বাঁধ ও ব্রিজের উপর দিয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
অপর এক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বুরহানের বাহিনী এসএএফ রাজধানীর প্রবেশদ্বার, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও স্থাপনাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। আরএসএফের সামরিক ঘাঁটিগুলোও নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয় তারা।
এছাড়া পুরো রাজধানী নিয়ন্ত্রণে আসার পর ইতোপূর্বে প্রেসিডেন্ট পদে থাকা আব্দুল ফাত্তাহ আল বুরহান প্রেসিডেন্ট ভবনে পৌঁছলে রাজধানী খুরতুম বিদেশী অপশক্তিদের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী বাহিনী থেকে মুক্ত হয়েছে বলে ঘোষণা দেন।
সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, গৃহযুদ্ধে জর্জরিত সুদানে ২০২৩ এর এপ্রিল থেকে নতুন সংঘাতের সূত্রপাত হয়। বিরোধ নিরসনে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার পন্থা ও ক্ষমতা ভাগাভাগির ব্যাপারে পক্ষ-বিপক্ষের মাঝে আলোচনা হয়। আলোচনায় একটি সমাধানেও পৌঁছেছিলো আব্দুল ফাত্তাহ বুরহানের সরকার ও আধা সামরিক বাহিনী আরএসএফ প্রধান হামদান দাগলোর নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ। অপেক্ষা ছিলো শুধু শেষবারের মতো একটি আনুষ্ঠানিক বৈঠকের, যেখানে উভয়পক্ষ তাদের মেনে নেওয়া রাষ্ট্র পরিচালনা নীতি ও ক্ষমতা ভাগাভাগির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিবে।
পুরো মুসলিম বিশ্ব অপেক্ষা করছিলো সুদানে নতুন ভোর দেখার। কিন্তু না, নতুন ভোর আসেনি যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদানে। শনিবার (১৫ এপ্রিল) সকালে তারা আবার সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।
এক্ষেত্রে কারা প্রথমে হামলা চালিয়েছে এবিষয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা সুদানের সেনাবাহিনী আর ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বে থাকা আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) একে অপরের প্রতি পাল্টা অভিযোগ আনে।
জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক মহল সংঘাত বন্ধের আহবান জানালেও উভয় পক্ষ তাদের লড়াই অব্যাহত রাখে।
আধাসামরিক আরএসএফ বাহিনীর প্রধান জেনারেল মুহাম্মদ হামদান দাগলো ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, সব সামরিক ঘাঁটি দখল না করা পর্যন্ত তার সেনারা লড়াই চালিয়ে যাবে।
অপরদিকে সুদানের ক্ষমতা গ্রহণকারী অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আব্দুল ফাত্তাহ আল-বুরহান ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, আরএসএফকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত সব ধরণের শান্তি আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়া হবে।
সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুসারে, আরএসএফ প্রধান দাগলো এবং সেনাপ্রধান আব্দুল ফাত্তাহ বুরহান একে অপরের সহযোগী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ২০১৯ সালে সুদানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তারা এক হয়ে কাজ করেন। ২০২১ সনের সামরিক অভ্যুত্থানেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
বিশ্লেষক ও সংবাদমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসার পর যখন লক্ষাধিক সেনা বিশিষ্ট আধা সামরিক বাহিনী আরএসএফকে সুদানের সেনাবাহিনীর সাথে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন থেকে দুই বন্ধুর মাঝে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এজন্য যে, আরএসএফকে মূল সেনাবাহিনীর সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হলে সেই বাহিনীর নেতৃত্বে কে থাকবে? কারণ প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ বুরহান আগ থেকেই সুদান সেনাবাহিনীর প্রধান পদে রয়েছেন। আরএসএফ যদি মূল সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় তখন হামদান দাগলোর ক্ষমতা খর্ব হবে। সবচেয়ে বড় কথা সে তার সামরিক শক্তি হারিয়ে ফেলবে।
কাতার, মিশর ও তুরস্ক শান্তিপূর্ণভাবে দেশটির গৃহযুদ্ধ থামাতে চেয়েও ব্যর্থ হয়। প্রতিবারই বিরোধ নিষ্পত্তির আগ মুহুর্তে অজ্ঞাত হামলার ঘটনা ঘটে।
এছাড়া বিরোধী পক্ষ বলে বিবেচিত হামদান দাগলোর আরএসএফ মূলত ইসরাইল ও আরব আমিরাত দ্বারা সমর্থিত বাহিনী ছিলো। যা আল জাজিরা, মিডল ইস্ট মনিটর সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রতিবেদনে উঠে আসে।
উল্লেখ্য, খ্রিস্টান মিশনারীদের অপতৎপরতা ও পশ্চিমা ষড়যন্ত্রে বৃহত্তর সুদান দুই ভাগ হয়ে যায়। সৌহার্দপূর্ণ সুদানের দক্ষিণ অংশ মুসলিমদের থেকে পৃথক হতে চায় ও আলাদা ভূখণ্ড চায় মর্মে প্রচারণা চালায়। বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে মুসলিমদের খ্রিস্টান নিপীড়ন হিসেবে তুলে ধরে অপ-প্রচার চালায়। সাথে যুক্ত হয় দক্ষিণের তেল ও খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মূল সরকারের সাথে দ্বন্দ্ব। শুরু হয় সংঘাত। এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে অর্থ ও রাজনৈতিক সহায়তা দিয়ে আরো উস্কে দেওয়া হয়। এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে খ্রিস্টানদের সাথে মুসলিমদের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। অথচ দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে সম্পৃক্ত সুদানের মূল সরকার ও দক্ষিণের কর্তৃপক্ষ দু’পক্ষই ছিলো মুসলিম। শেষমেশ ২০১১ সালের ৯ জুলাই জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে দক্ষিণ সুদানকে খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিতে সম্মত হয় সুদানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির। সাক্ষর করেন চুক্তিতে। জন্ম নেয় দক্ষিণ সুদান নামে নতুন একটি রাষ্ট্র। যার প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী সালভা কিরকে।
ইউরোপ-আমেরিকার ন্যায় উন্নতি ও ভাগ্য বদলের আশায় পশ্চিমাদের প্ররোচনা ও অপতৎপরতায় সুদান থেকে পৃথক হয়ে গেলেও দক্ষিণ সুদানের ভাগ্য ফিরেনি। বরং সুদান থেকে তাদের অবস্থা আরো খারাপের পথে। তেল ও খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তারা নিজেরাই আবার দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। পেছনে রয়েছে যথারীতি লোভী পশ্চিমারা, যারা নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারে ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছে।
সূত্র: আল জাজিরা









