বুধবার | ৩১ ডিসেম্বর | ২০২৫
spot_img

আধুনিক বাংলাদেশে হিজরী সনের প্রাসঙ্গিকতা

শেখ ফজলুল করীম মারুফ


বাংলাদেশে ইসলাম এসেছে ৬৯ হিজরী মোতাবেক ৬৪৮ ঈসায়ী সালে। লালমনিরহাটের মসজিদ তাই বলছে। ৪৪৫ হিজরী সালে মোতাবেক ১০৫৩ সাল নাগাদ শাহ সুলতান রুমি, বাবা আদম শহীদ, শাহ সুলতান বলখি মাহিসওয়ার প্রমুখ সুফিদের আগমন এর কথা সুনির্দষ্টভাবে জানা যায়।

বাংলায় রাজনীতিকভাবে ইসলাম এসেছে ১২০৩/৪ সালে। এবং বিক্ষিপ্ত কয়েকটি ভুখণ্ডকে একত্রিত করে বাংলা নামে একটি রাজনীতিক একক ভূখন্ড হিসেবে গড়ে তোলেন ১৩৫২ সালে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ। তিনিই বাংলা ভূখন্ড, ভাষা ও জাতীয়তা গড়ে তোলেন।

তারও আগে থেকেই বাংলার সুলতানি শাসনামলের যাবতীয় কাজ হিজরী সনকে ভিত্তি করে পরিচালিত হতো।

অর্থ্যাৎ বাংলা রাজনীতিক একক হিসেবে সৃষ্টির সময় থেকেই হিজরী সন এখানে প্রচলিত। বাংলার সাথে হিজরী সনের সম্পর্ক একেবারে সূচনা থেকে। পরে যখন কৃষি ও খাজনা আদায় সহজার্থে নিজস্ব সনের উদ্ভব হয় তাও হিজরী সন থেকেই করা হয়েছে। ফলে বাংলার সাথে হিজরী সনের সম্পর্ক আজন্ম।

সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের আগ্রাশনের পরে হিজরী সনের ব্যবহার রাষ্ট্রীয় কাজে কমে গেলেও এখনো বাংলাদেশের রাষ্ট্রিয় ব্যবস্থাপনায়, সংস্কৃতিতে, সাহিত্যে, অর্থনীতিতে, মানুষের খাদ্যাভ্যাসে, জীবনের সময় ঘড়িতে, রাজনীতিতে, শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় এবং উৎসব-পার্বনে হিজরী সন ও হিজরী তারিখ ওৎপ্রোতভাবে জড়িত আছে।

এই আলোচনায় আমরা হিজরী সনের সাথে বাংলাদেশের মানুষের জীবনের সম্পর্ক নিয়ে খানিক আলোকপাত করবো ইনশাআল্লাহ।

সরকারী ছুটির বড় অংশটাই নির্ধারিত হয় হিজরী সনকে কেন্দ্র করে

সরকারী ছুটি ব্যবস্থাপনায় হিজরী সন
২০২১ সালে সরকারীভাবে মোট ১৪দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। তারমধ্যে ৪ দিন হিজরী তারিখ নির্ভর। নির্বাহী আদেশে ছুটি আছে ৮ দিন। তারমধ্যে ৭ দিনই হিজরী তারিখ নির্ভর। এছাড়াও ঐচ্ছিক পর্বে ৫ দিন হিজরী তারিখ নির্ভর ছুটি আছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় এবং সমন্বিত ছুটিও হয় হিজরী তারিখ নির্ভর।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে হিজরী সন

ঈদুল ফিতর
দেশে প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপনে বাজারে একসঙ্গে নগদ টাকার চাহিদা এত বাড়ে যে গ্রাহকের দাবি মেটাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে টাকা জোগাড়ে ব্যস্ত হতে হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নগদ নতুন নোটের খাজাঞ্চিখানার দুয়ার খুলে দিতে হয়।

 

মূলত ঈদকে ঘিরে চাঙ্গা হয় দেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাব মতে, রোজার মাসে পণ্য বিক্রি তিন গুণ বেড়ে যায়। সে হিসাবে রোজার এক মাসে ঈদের পোশাক থেকে শুরু করে ভোগ্যপণ্য বিক্রি হয় প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার।

পোশাকের দোকানেই ঈদের কেনাকাটা ৮০ হাজার কোটি টাকারও বেশি হয় বলে জানান দোকান মালিক সমিতির নেতারা।

ঈদকে ঘিরে অর্থনীতির সব খাতেই গতি ফিরে আসে। চাকরিজীবীরা ১২ হাজার কোটি টাকার ঈদ বোনাস তোলে। এর প্রায় পুরোটাই যায় ঈদের বাজারে।

জাকাতকে ঘিরে গরিব-অসহায় মানুষের মধ্যেও ঈদ অর্থনীতির ছোঁয়া লাগে।

সারা বছরের মধ্যে রমজান ও ঈদকে ঘিরে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স আসে সবচেয়ে বেশি। যার বেশির ভাগই চলে যায় গ্রামীণ মানুষের হাতে।

ঈদের মাসে যেমন সারা দেশের শপিং মল বা মার্কেটগুলো গতিশীল হয়, তেমনি কুটিরশিল্প, তাঁতশিল্প, দেশীয় বুটিক হাউসগুলোয় বাড়ে কর্মচাঞ্চল্য, বাড়ে আর্থিক লেনদেন।

ঈদকে ঘিরে চাঙ্গা হয় দেশের অর্থনীতি

বিপুল অর্থ ব্যয়ের কারণে অর্থনীতিতে বড় ধরনের গতিশীলতা আসে। ঈদ উপলক্ষে রেকর্ড গতিতে দেশের অর্থনীতিতে জমা হয় প্রবাসীদের রেমিট্যান্স। শুধু মে মাসে ১২৬ কোটি ৭৬ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা চলতি অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

ঈদের কেনাকাটায় এটিএম বুথে প্রতিদিন ১৫ কোটি টাকার বেশি উত্তোলন করছে গ্রাহকরা। এ ছাড়া মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হচ্ছে হাজার কোটি টাকার বেশি। মোবাইলে লেনদেন প্রতিদিনই বাড়ছে।

২০১৯ সালে ঈদুল ফিতরের সময় মানুষের চাহিদা পূরণে বাজারে অতিরিক্ত ২৫ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছাড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঈদ সামনে রেখে জমজমাট অনলাইনের ঈদের বাজারও।

রোজার আগে অর্থনীতিতেএক ধরনের প্রভাব থাকে। এ মাসে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। রোজা শুরুর প্রায় ছয় মাস আগে থেকেই মূলত শুরু হয় রোজাকেন্দ্রিক অর্থনীতি। কেননা রোজার মাসের জন্য পণ্য আমদানি কার্যক্রম অনেক আগেই শুরু করতে হয় ব্যবসায়ীদের। এমনকি সরকারি পর্যায়েও অনেক পণ্য আমদানি করতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঈদ উপলক্ষে অর্থনীতি হয় গ্রামমুখী। গ্রামের হাট-বাজার দারুণ চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের এক তথ্য মতে, ঈদে পোশাকসহ যাবতীয় পরিধেয় খাতে ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা, জুতা-কসমেটিকস খাতে তিন হাজার কোটি টাকা, ভোগ্যপণ্য খাতে সাত হাজার কোটি টাকা, জাকাত-ফিতরা ও দান-খয়রাত খাতে ৩৮ হাজার কোটি টাকা, যাতায়াত বা যোগাযোগ খাতে ১০ হাজার কোটি টাকা, সোনা-ডায়মন্ড খাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা, ভ্রমণ খাতে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা, ইলেকট্রনিকস খাতে চার হাজার কোটি টাকা, স্থায়ী সম্পদ ক্রয় খাতে এক হাজার কোটি টাকা, পবিত্র ওমরাহ পালন খাতে তিন হাজার কোটি টাকা, ও আইন-শৃঙ্খলাসহ অন্যান্য খাতে এক হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয় ।

অর্থনীতির আরো অনেক খাত রয়েছে যেখানে ঈদকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের বাণিজ্য হয়ে থাকে। বিশেষ করে ফার্নিচার, গাড়ি ও আবাসন শিল্পে বড় ধরনের কেনাকাটা হয়ে থাকে।

এ ছাড়া উচ্চবিত্তের প্রায় এক লাখ মানুষ দেশের বাইরে ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কেনাকাটার জন্য পাড়ি জমায়। গড়ে এদের ৫০ হাজার টাকা খরচ হলেও তাতে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়।

এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে ঘুরে বেড়ানো, বিভিন্ন আনন্দ-বিনোদন বাবদ আরো দেড় হাজার কোটি থেকে দুই হাজার কোটি টাকা খরচ হয় ঈদে।

ঈদুল আজহা
ঈদুল আজহা উদযাপনে অর্থনীতিতে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ, শিল্প উপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটে। এ উৎসবে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ব্যাপক আর্থিক লেনদেনসহ বহুমুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, যা গোটা অর্থনীতি তথা দেশজ উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় শনাক্তযোগ্য প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

হজ পালন উপলক্ষে বৈদেশিক মুদ্রাসহ বিপুল সংখ্যক অর্থ লেনদেন হয়ে থাকে। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রীদের মাধ্যমে বা দ্বারা প্রতি বছর গড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়।

ঈদুল আজহা অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব রাখে

২০১৯ সালে ঈদুল আজহার অর্থনীতি ছিল পিআরআইয়ের তথ্যমতে, ৪৫ হাজার কোটি টাকা। গবাদি পশু বিক্রি হয়েছিল ২৮ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকার; বাকি ১৫-১৬ হাজার কোটি টাকা ছিল পরিবহন, পর্যটন এবং বিভিন্ন পণ্যাদি বিক্রি থেকে।

কুরবানিকৃত পশুর সরবরাহ ও কেনাবেচার শুমার ও পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় চাদা, টোল, বখশিশ, চোরাকারবার, ফড়িয়া, দালাল, হাশিল, পশুর হাট ইজারা, চাদিয়া, বাঁশ-খুঁটির ব্যবসা, পশুর খাবার, পশু কুরবানি ও কসাইয়ের খরচ এমনকি পশুর সাজগোজ বাবদও বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতবদল হয়ে থাকে অর্থাৎ অর্থনীতিতে ফর্মাল-ইনফর্মাল ওয়েতে আর্থিক লেনদেন বা মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়।

কুরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিক্রয় ও ব্যবহার উপলক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের ও প্রতিষ্ঠানের কর্মযোজনা সৃষ্টি হয়। আমাদের অর্থনীতিতে বিশেষ করে রপ্তানি বাণিজ্যে, পাদুকা শিল্পে পোশাক, হস্তশিল্পে এক অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

এই চামড়া সংগ্রহ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে ১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা জড়িত।

মাংস রান্নার কাজে ব্যবহৃত মসলা বাবদ প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে এ সময়ে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় পরিবহন খাতে সাকল্যে ২ হাজার কোটি টাকার বাড়তি ব্যবসা বা লেনদেন হয়েছিল। (এই তথ্যগুলো ২০১৯ সালের। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মজিদ এর লেখা থেকে নেয়া)

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে হিজরী সন
সংস্কৃতি হলো, মানুষের জীবনাচার। যা কিছু মানুষ একযোগে প্রায় একই ভাবে পালন করে তাই সেদেশের সংস্কৃতি।

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে যে কতগুলো দিন সার্বজনীন তারমধ্যে শবে বরাত, শবে কদর, ইফতার, ঈদ, তারাবিহ, আশুরা, ঈদে মিলাদুন্নাবী অন্যতম। এই দিনগুলোকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী বিশেষ ধরনের আয়োজন হয়।

শবে বরাতকে কেন্দ্র করে দেশেব্যাপী বিশেষ খানা, প্রতিবেশিদের আপ্যায়ন করা, মা-বাবাসহ পুর্বপুরষের কবর জেয়ারত, নতুন প্রজন্মকে আগের প্রজন্মের সাথে মেলবন্ধন তৈরি করে দেয়া, একে অপরের কাছে যাবতীয় অপরাধ থেকে ক্ষমা চাওয়া, রাতভর নামাজ পড়া ও শেষ রাতে কায়মোনোবাক্যে প্রার্থণা করা বাংলাদেশের সংস্কৃতি।

শবে কদরে মসজিদে মসজিদে ওয়াজ, রাতভর নামাজ, পরের দিন বিশেষ ইফতারি, খতমে কোরান ইত্যাদিও দেশব্যাপী সাধারন চিত্র।

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে যে কতগুলো দিন সার্বজনীন তারমধ্যে শবে বরাত, শবে কদর, ইফতার, ঈদ, তারাবিহ, আশুরা, ঈদে মিলাদুন্নাবী অন্যতম

পুরান ঢাকায় ইফতারির বাহারী আয়োজন, বাড়ি রাড়িতে ভাজা-পোড়া, ছোলা-মুড়িসহ সকলে সম্মিলিতভাবে ইফতারি করা, সব ধরনের সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সকলে বসে আয়োজন করে ইফতারি করাও এদেশের বহুল চর্চিত সংস্কৃতি।

ঈদে মীলাদুন্নাবীর আয়োজন যে কত বিস্তৃত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারাবিহ নিয়ে কবি জসি উদ্দিনের কবিতা উল্লেখ করাই যথার্থ হবে যে, হিজরী তারিখ আমাদের গ্রামীন সমাজের জীবন কিভাবে বদলে দেয় তা এই পংক্তিতে ফুটে উঠেছে

তারাবি নামাজ পড়িতে যাইব মোল্লাবাড়িতে আজ,

মেনাজদ্দীন, কলিমদ্দীন, আয় তোরা করি সাজ।

চালের বাতায় গোঁজা ছিল সেই পুরাতন জুতা জোড়া,

ধুলাবালু আর রোদ লেগে তাহা হইয়াছে পাঁচ মোড়া।

তাহারি মধ্যে অবাধ্য এই চরণ দুখানি ঠেলে,

চল দেখি ভাই খলিলদ্দীন, লুন্ঠন-বাতি জ্বেলে।

ঢৈলারে ডাক, লস্কর কোথা, কিনুরে খবর দাও।

মোল্লাবাড়িতে একত্র হব মিলি আজ সার গাঁও।

হিজরী তারিখ নির্ভর সমাজ-সম্পর্ক কিভাবে বদলে যায় তা এই পংক্তিতে ফুটে উঠেছে

গইজদ্দীন গরু ছেড়ে দিয়ে খাওয়ায়েছে মোর ধান,

ইচ্ছা করিছে থাপপড় মারি, ধরি তার দুটো কান।

তবু তার পাশে বসিয়া নামাজ পড়িতে আজিকে হবে,

আল্লার ঘরে ছোটোখাটো কথা কেবা মনে রাখে কবে!

মৈজদ্দীন মামলায় মোরে করিয়াছে ছারেখার,

টুটি টিপে তারে মারিতাম পেলে পথে কভু দেখা তার।

আজকে জামাতে নির্ভয়ে সে যে বসিবে আমার পাশে,

তাহারো ভালর তরে মোনাজাত করিব যে উচ্ছাসে।

মাহে রমজান আসিয়াছে বাঁকা রোজার চাঁদের ন্যায়,

কাইজা ফেসাদ সব ভুলে যাব আজি তার মহিমায়।

হিজরী তারিখকে কেন্দ্র করে বছরে একমাস মানুষের খাবারের ধরণ, ঘুমের সময় ও দৈনান্দিন কর্মসূচি বদলে যায়। সবমিলিয়ে হিজরী তারিখ আমাদের জীবনে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। এবং তা করে সার্বজনীনভাব। এতো ব্যাপকভাবে আর কোন কিছুই এই জাতীকে প্রভাবিত করে না। এমনকি পয়লা বৈশাখও শহুরে সংস্কৃতি। কিন্তু গত হাজার বছর ধরে হিজরী তারিখ নির্ভর এই দিনগুলো বাঙ্গালীর জীবনকে প্রভাবিত করে আসছে।

এই দিনগুলোকে সংস্কৃতি হিসেবে অনেকে মানতে চাইবে না। অনেকে জায়েজ-না-জায়েজের প্রশ্ন আনতে পারেন। কিন্তু সংস্কৃতির সবগুলো মাত্রাই এই দিনগুলো বিদ্যমান।

খাদ্যাভ্যাসে হিজরী সন
বছরের একটি সময়ে বাংলাদেশের মানুষের আমিষ গ্রহণের মাত্রা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। এবং প্রায় সার্বজনীনভাবে ধনী-গরীব, শহুরে-গ্রামে সর্বত্র এই আমিষ গ্রহণ মাত্রা বেড়ে যায়। এই সময়টাও হিজরী তারিখ নির্ভর। বারো মাসের আরেকটি মাসে মানুষের প্রচলিত খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্যগ্রহণের সময়ে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এটাও হিজরী তারিখ নির্ভর।

রমজান মাসে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস ব্যপক পরিবর্তন আসে

জীবন ঘড়িতে হিজরী সন
জীবন ঘড়ি যে কোন সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের জীবন ঘড়ি এখন বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মতোই। প্রায় মধ্যরাতে ঘুমাতে যাওয়া এবং দিনের প্রথম প্রহর অবধি ঘুমিয়ে কাটানো। কিন্তু হিজরী সনের একটি মাসে এই অবস্থায় পরিবর্তন আছে। অফিস টাইমে পরিবর্তন আসে।

শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় হিজরী সন
বাংলাদেশের একটি নির্দিষ্ট মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় এটা গুরুত্বপূরর্ণ। এটাও হিজরী তারিখ নির্ভর।

রাজনীতিতে হিজরী সন
বছরের একটি মাস বাংলাদেশের রাজনীতি শান্ত পরিবশে বিরাজ করে। পারস্পরিক সৌহার্দ বৃদ্ধি পায়। নতুন মেরুকরণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইফতার পার্টির মতো রাজনীতিক প্রভাব বিস্তারি অনুষ্ঠান ব্যাপক হারে অনুষ্ঠিত হয়। ফলে রাজনীতির চরিত্র বদলে হিজরী সন গুরুত্ববহ।

রজমান মাস উপলক্ষে বাংলাদেশের রাজনীতি শান্ত পরিবশে বিরাজ করে

উৎসবে হিজরী সন
এটা বলা বাহুল্য যে, বাংলাদেশের প্রধান উৎসব হিজরী তারিখ নির্ভর।

জীবনে হিজরী সন
বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ। উপকুলীয় অঞ্চলে জোয়ার-ভাটা অতিমাত্রায় জীবন ঘনিষ্ঠ। জেলেদের জীবন, নৌ-চলাচল এমনকি বন্দর ব্যবস্থাপনায় জোয়ার-ভাটা গুরুত্বপূর্ণ। দুর্জোগ ব্যবস্থাপনায় জোয়ার-ভাটা, আমাবস্যা-পূর্ণিমার তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ণিমার চাঁদ বাংলা সাহিত্যের বহুল ব্যবহৃত উপাদান। তাও হিজরী তারিখি নির্ভর।

সামগ্রিকভাবে
হিজরী সন কেবল ইবাদত সম্পর্কিত না। বরং বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, জীবন, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, উৎসবসহ নিত্যদিনের কাজের সাথে জড়িত। সেজন্য হিজরী সনের চর্চা করা জরুরী।

১৪৪৩ হিজরী সনের সূচনাপর্বে আল্লাহ তায়ালা আমদেরকে আধুনিক সমাজে হিজরী সনের প্রাসঙ্গিকতা অনুধাবন করা এবং তাকে জীবনের চর্চায় আনার তৌফিক দান করুন এই প্রত্যাশায়…।

spot_img
spot_img
spot_img
spot_img

সর্বশেষ