বুধবার, মার্চ ১২, ২০২৫

আজ মুসলিমদের ঐতিহাসিক ভারত বিজয় বার্ষিকী

আজ পবিত্র রমজানুল মুবারকের ৬ষ্ঠ দিন। ৯৩ হিজরীর আজকের দিনে হিন্দু ব্রাহ্মণদের সর্বশেষ রাজা, রাজা দাহিরকে পরাজিত করার মধ্যদিয়ে ভারতবর্ষের সিন্ধু বিজয় করেছিলেন উমাইয়া খেলাফতের তরুণ সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম আস-সাকাফী। এজন্য তাকে ও তার বাহিনীকে গ্রহণ করতে হয় অভিনব যুদ্ধকৌশল ও ধারণ করতে হয় পাহাড়সম দৃঢ়তা।

কেননা ভারতবর্ষে বসবাসরত সম্প্রদায়ের অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধকৌশল ও যুদ্ধ বাহন ছিলো অনেকটাই ভিন্ন। ভৌগোলিক দূরত্ব, পাহাড় ও অসংখ্য নদীর সমন্বয়ে তৈরি বিচিত্র পরিবেশও ছিলো খেলাফতের মুসলিম বাহিনীর জন্য প্রতিকূল। কেননা একই সাথে পাহাড় আর অসংখ্য নদীময় ভূখণ্ডে এর আগে কখনো যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি তারা। ভারতবর্ষের রাজাদের হস্তি বাহিনীও ছিলো প্রতিকূলতার অন্যতম কারণ।

সিন্ধু বিজয়ের জন্য উমাইয়া খেলাফতের বাহিনীকে ৯০হিজরী থেকে বেশ কয়েকবার হামলা চালাতে হয়। পরিবর্তন করতে হয় যুদ্ধকৌশল। পরিশেষে ৯৩ হিজরিতে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যখন তরুণ সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের যুদ্ধকৌশলে ৫দিনের তীব্র লড়াইয়ে সিন্ধু মুসলিমদের পদাবনত হয়। মৃত্যু হয় ব্রাহ্মবাদী হিন্দু সাম্রাজ্যের সেই অত্যাচারী শাসকের, যার কাছে আশ্রয় পেতো আরব থেকে পালিয়ে আসা খেলাফতের বিদ্রোহীরা। যার ছত্রছায়ায় সাগরপথে দস্যুতা করে বেড়াতো ভারতবর্ষের সবচেয়ে কুখ্যাত দেবল জলদস্যুরা। লুটতরাজ চালাতো মুসলিমদের বাণিজ্য জাহাজে। অপহরণ করতো বর্তমান শ্রীলঙ্কা থেকে আরবের উদ্দেশ্যে সফরকারী মুসলিম নারীদের।

সমুদ্রপথে মুসলিম জাহাজে দস্যুতা ও ভারতবর্ষের নও-মুসলিম নারীদের অপহরণে রাজা দাহিরের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা এবং সিন্ধুর সাধারণ জনগণের উপর সীমাহীন অত্যাচার মুসলিমদের সিন্ধু আক্রমণের প্রধান কারণগুলোর অন্যতম হলেও ঐতিহাসিক এক বর্ণনা মতে, এর সূত্রপাত ঘটে দাহিরের হাতে বন্দী এক মুসলিম নারীর চিঠি থেকে। যিনি ঈমান ও ইজ্জত রক্ষায় তৎকালীন খেলাফতের প্রধান প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে চিঠি মারফত সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন।

রাজা দাহিরের অত্যাচার ও ঔদ্ধত্যের সমুচিত জবাব দিতে ৯৩ হিজরীর পূর্বে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ যথাক্রমে ওবায়দুল্লাহ ও বুদাইলের নেতৃত্বে দু’দুটি অভিযান প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু দুটি অভিযানই ব্যর্থ হয়। পরিশেষে রাজা দাহিরকে শায়েস্তা করতে তিনি রণ-বিদ্যায় পারদর্শী স্বীয় ভাতিজা ও জামাতা ১৭ বছরের তরুণ ইমামুদ্দিন মুহাম্মদ বিন কাসিম আস-সাকাফীর নেতৃত্বে ৩য় বারের মতো অভিযান প্রেরণ করেন।

চাচার মুখে রাজা দাহিরের অত্যাচারের কথা শুনতে পেয়ে পারস্যের সিরাজ/শাইরাজের তরুণ শাসক মুহাম্মদ বিন কাসিমও প্রতিকূল ও অজানা পরিবেশে অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন। মনস্থির করেছিলেন রাজা দাহিরকে দেখে নেওয়ার এবং সিন্ধু বিজয় করে ছাড়ার। সাথে নিয়েছিলেন ৬ হাজার সিরীয় ও ইরাকি সৈন্য, সমানসংখ্যক উট আরোহী ও ২ হাজার জনের তীরান্দাজ বাহিনী। এছাড়া মাকরান হয়ে অতিক্রমের সময় সেখানকার শাসনকর্তা মুহাম্মদ হারুনও সিন্ধু বিজয়ের জন্য তাকে অস্ত্রশস্ত্র, সেনা ও রসদ দিয়ে সহযোগিতা করেন।

তরুণ সেনাপতি এই বাহিনী নিয়ে দেবল বন্দরের অদূরে থাট্টায় (বর্তমান করাচী থেকে ১০০ কি.মি. দূরে অবস্থিত শহর) এসে অবস্থান নেন। খেলাফত বাহিনীর আগমনের খবরে ব্রাহ্মণদের দ্বারা নিপীড়িত হিন্দু ও বৌদ্ধদের অনেকেই সেই দলে যোগ দেন। বিভিন্নভাবে মুসলিম বাহিনীকে সাহায্য করেন।

রাজা দাহিরের রাজত্ব ধ্বংসে সর্বপ্রথম তিনি ব্রাহ্মণ ও রাজপুতদের দ্বারা সুরক্ষিত শক্তিশালী দেবল দূর্গ দখল করে নেন। দূর্গটি ছিলো রাজা দাহিরের দম্ভ ও হিন্দু সেনাদের মনোবল সুউচ্চ থাকার অন্যতম কারণ। কেননা এর আগেও পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানো আরব মুসলিম বাহিনীর এখানে পরাজয় ঘটেছিলো।

এছাড়া এতে একটি বড় মন্দির ছিলো। যেখানে সর্বদা একটি লাল পতাকা উত্তলিত থাকতো। সিন্ধুর অধিবাসী ও হিন্দু সেনারা বিশ্বাস করতো, যতদিন পতাকাটি উড্ডীন থাকবে ততদিন তাদের পরাজয় ঘটবে না। তাই পরিখা খনন করে সৈন্য প্রেরণের পর প্রথমেই মুহাম্মদ বিন কাসিম সেই পতাকাটিকে লক্ষ্যবস্তু বানান। এর মাধ্যমে হিন্দু সেনাদের মনোবল ভেঙে দিয়ে সহজেই দূর্গটি দখলে নেন। একটি মসজিদ নির্মাণ, ৪ হাজার সৈন্য ও শাসক নিযুক্ত করে ক্রমান্বয়ে নিরুন, সেহওয়ান ও সিসাম নগরীর দিকে অগ্রসর হোন। এসব নগরী ও দুর্গপতিরাও মুসলিম বাহিনীর কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিলে দেবল দূর্গ থেকে পালিয়ে রাওয়ার দূর্গে আশ্রয় নেওয়া রাজা দাহির বিচলিত হয়ে পড়েন এবং সিন্ধু নদের অপর প্রান্তে বিশাল সেনা ও হস্তি বাহিনী জড়ো করেন। মুসলিম বাহিনীর তুলনায় কয়েক গুণ বড় বাহিনী জড়ো করেও শেষ রক্ষা হয়নি দাম্ভিক ও অত্যাচারী রাজা দাহিরের। তরুণ সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম ও মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শোচনীয়ভাবে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

নথিপত্র ও ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুযায়ী, সিন্ধু নদী পার হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া মুহাম্মদ বিন কাসিম শেষমেশ দাহিরের শিরচ্ছেদ করে মস্তকটি চাচা হাজ্জাজের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

দাহিরের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী, পুত্র জয়পাল ও কুফি যথাক্রমে রাওয়া দূর্গ, ব্রাহ্মণাবাদ ও আলোয়ার নগরী রক্ষার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু দূর্গ ও নগরগুলোও মুসলিমদের করায়ত্তে চলে আসে।

কথিত আছে, রাওয়ার দূর্গের পতন আসন্ন দেখে দাহিরের স্ত্রী রানী বাই তার সহচরদের নিয়ে অগ্নিকুণ্ডে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিম ভারতবর্ষে সর্বশেষ যে অভিযান পরিচালনা করেন তা ছিলো মুলতানে। এটি ছিলো ব্রাহ্ম হিন্দু রাজ্যের সর্বশেষ শক্তির উৎস ও ৪-৫টি নদী নিয়ে গঠিত অত্যন্ত সুরক্ষিত একটি শহর। সেখানকার এক হিন্দু সভাসদের পরামর্শে সুরক্ষিত নগরীটিও সফলভাবে অবরোধ করতে সক্ষম হয় মুসলিম বাহিনী। কিন্তু সফল অবরোধ সত্ত্বেও অভিযানে কঠিন বাধার সম্মুখীন হয় মুসলিমরা। পরাজিত হওয়ার আগ পর্যন্ত নগরীটির হিন্দুরা প্রায় ২ মাস মুসলিম বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখে।

মুলতান পতনের মধ্যদিয়ে তৎকালীন ভারতের অন্যতম ব্রাহ্মণ রাজবংশের রাজত্বের পুরোপুরি পতন ঘটে। সিন্ধু ও মুলতান অধীনে আসে উমাইয়া খেলাফতের। সুগম হয় ভারত জুড়ে ইসলামী শাসনের পথ।

spot_imgspot_img

সর্বশেষ

spot_img
spot_img
spot_img
spot_img