তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের উপদেষ্টা ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ইয়াসিন আক্তাই বলেছেন, “আমরা যদি ‘চোরাবালি’ বলি, তবে সেটা দখলদারদের জন্যই ‘চোরাবালি’। কিন্তু আফগানিস্তান এমন এক দেশ, যেখানে দরজা দিয়ে শিষ্টাচার মেনে প্রবেশ করতে চাওয়া মানুষের জন্য এটি পৃথিবীর জান্নাত; এর মানুষের কারণে, আবহাওয়ার কারণে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে এবং আল্লাহর দান করা সব নিয়ামতের কারণে।”
তিনি বলেন, আফগানিস্তানের বর্তমান বাস্তবতা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত চিত্রের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। ইমারাতে ইসলামিয়া (তালেবান) দখলদার বাহিনীকে উৎখাতের পর এমন সব পদক্ষেপ নিয়েছে, যা অতীতে প্রায় অসম্ভব বলে ধরা হতো।
চার বছর আগে থেকে আজ পর্যন্ত পরিবর্তন
২০২১ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো মিত্ররা আফগানিস্তান ত্যাগ করে, যা ইয়াসিন আক্তাইয়ের ভাষায় দখলদারদের জন্য এক “চোরাবালি” থেকে পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু দেশটির জন্য এটি ছিল দখলমুক্তির সূচনা। আক্তাই বলেন, এই চার বছরে আফগানিস্তান এক নতুন বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে, যেখানে নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা হাত ধরাধরি করে চলছে। সরকার প্রথমবারের মতো সর্বস্তরের নাগরিককে উন্নয়নের জন্য এগিয়ে আসতে আহ্বান জানাচ্ছে।
তালেবানের কূটনৈতিক দৃঢ়তা
আক্তাই স্মরণ করিয়ে দেন, শেষ পর্যায়ের প্রস্থান আলোচনায় যখন প্রস্তাব করা হয়েছিল দূতাবাসে কিছু সৈন্য রাখা হোক, তখন তালেবান প্রতিনিধি জবাব দিয়েছিলেন,
“আমরা একটি পিস্তল রাখার অনুমতিও দেব না। যদি নিরাপত্তার কথা বলেন, তাহলে যে কেউ এই দেশে পদার্পণ করলে আমরা তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারব, আপনাদেরও করব, অতিথি হিসেবে মাথার উপরে স্থান দেব। কিন্তু দখল বা গায়ের জোরে আসবেন না। যখনই এভাবে আসবেন, আপনাদের সঙ্গে শেষ যোদ্ধা অবধি যুদ্ধই হবে একমাত্র জবাব।”
আক্তাই বলেন, এই দৃঢ় অবস্থানই আফগানিস্তানের সার্বভৌম মর্যাদার প্রতীক। আজ দেশটি বৈধভাবে আসা সব মানুষের জন্য উন্মুক্ত, তাদের বিনিয়োগ, পর্যটন এবং উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
প্রথমবারের মতো রক্তপাতহীন ক্ষমতা পরিবর্তন
গত ৫০ বছরে আফগানিস্তানে প্রতিটি সরকার পরিবর্তন রক্তপাত, প্রতিশোধ এবং ‘দেওর-সাবিক’ ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে হয়েছে। কিন্তু তালেবানের দ্বিতীয় দফার শাসনে পরিস্থিতি ভিন্ন। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে প্রতিশোধের চক্র ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এমনকি তালেবানের শীর্ষ নেতৃত্বের কেউ কেউ নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ব্যতিক্রম রাখতে চাইলেও ইসলামী ইমারাতের আমীর মাওলানা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, কোনো ব্যতিক্রম হবে না। তার এই নির্দেশই চূড়ান্ত হয়, এবং সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা কার্যকর হয়।
এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশে এমন মানুষও প্রতিদিন তালেবান সদস্যদের সাথে একই রাস্তা, একই বাজারে চলাফেরা করছে, যারা অতীতে তাদের ওপর নির্যাতন, এমনকি হত্যাচেষ্টা চালিয়েছিল। চার বছরে এ ক্ষমার একটিও লঙ্ঘন ঘটেনি। আক্তাইয়ের মতে, এটি কেবল আফগানিস্তানের ইতিহাসেই নয়, বরং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সংকট ব্যবস্থাপনায় একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।
প্রবাসী আফগানদের প্রত্যাবর্তন
আক্তাই উল্লেখ করেন, এই সাধারণ ক্ষমার ঘোষণার পর বিদেশে থাকা লক্ষাধিক আফগান নাগরিক দেশে ফিরতে শুরু করেছে। তাদের মধ্যে অনেকে ২০, ৩০ এমনকি ৪০ বছর পর প্রথমবারের মতো দেশে পা রাখছেন। তারা বলছেন, দেশে এখন স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা রয়েছে, এবং সরকার উন্নয়নে সব নাগরিককে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে।
অর্থনীতি ও পর্যটনের উত্থান
আক্তাই জানান, তুর্কিশ এয়ারলাইন্স এখন প্রতিদিন বড় বিমানে ইস্তাম্বুল থেকে কাবুলে ফ্লাইট পরিচালনা করছে, যা সম্পূর্ণ ভরা অবস্থায় যাতায়াত করে। আগে আফগানিস্তানে যেতে একমাত্র বিকল্প ছিল কাম এয়ার, যেখানে বিমানের আসন পূর্ণতা প্রায় এক-তৃতীয়াংশেই সীমাবদ্ধ থাকত। এখন শুধু তুরস্ক থেকেই নয়, ইউরোপের অনেক দেশ থেকেও যাত্রীরা ইস্তাম্বুল হয়ে আফগানিস্তানে যাচ্ছেন।
যাত্রীদের মধ্যে ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, পর্যটক এবং বিপুল সংখ্যক প্রবাসী আফগান রয়েছেন। পর্যটন উন্নয়নে তালেবান সরকার প্রাণবন্ত, রসিকতাপূর্ণ ভাষায় ভিডিও প্রকাশ করে বিদেশি বিনিয়োগকারী ও ভ্রমণকারীদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, যা দেশের নতুন ইতিবাচক ভাবমূর্তিকে তুলে ধরছে।
মাদকবিরোধী নজিরবিহীন অভিযান
আক্তাই জোর দিয়ে বলেন, আফগানিস্তানের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে আফিম একটি বড় অর্থনৈতিক উৎস হতে পারত। কিন্তু ইসলামী ইমারাত হারামের কারণে এই চাষ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। আমীর আখুন্দজাদার সংক্ষিপ্ত নির্দেশ, “আফিমের চাষ, বাণিজ্য ও ব্যবহার নিষিদ্ধ” দেশব্যাপী কার্যকর হয়েছে।
এই নিষেধাজ্ঞা শুধু ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ নয়। চার বছর ধরে মাদক উৎপাদনকারী সব গাছের চাষ বন্ধ রয়েছে। এর পরিবর্তে পূর্বে আফিমক্ষেতে এখন জাফরান চাষ হচ্ছে, যা আফগানিস্তানের একটি মূল্যবান কৃষিপণ্য। যদিও এটি পুরোপুরি অর্থনৈতিক বিকল্প নয়, তবুও দেশের জন্য একটি টেকসই আয়ের উৎস হয়ে উঠছে।
আসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন
প্রায় ৩০ লাখ মাদকাসক্তকে শনাক্ত করে চিকিৎসার আওতায় আনা হয়েছে। তাদের অধিকাংশকে সফলভাবে সুস্থ করে তোলা হয়েছে। শুধু চিকিৎসাই নয়, তাদের বিভিন্ন পেশাগত প্রশিক্ষণ দিয়ে পুনর্বাসিত করা হয়েছে, যাতে তারা স্বনির্ভর হতে পারে। আক্তাই বলেন, এই কর্মসূচি বিশ্বের বহু দেশের মাদকবিরোধী প্রচেষ্টার তুলনায় অনন্য এবং কার্যকারিতার দিক থেকে অতুলনীয়।
সামাজিক জীবনের বাস্তবতা
আক্তাই উল্লেখ করেন, বাইরের বিশ্বের অনেকের ধারণার বিপরীতে আফগানিস্তানের সামাজিক জীবন অতটা দৃশ্যমান কঠোর নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে এটি স্বাভাবিক ও এমনকি অতিরিক্ত স্বস্তিদায়ক বলেও মনে হতে পারে। ইসলামী ইমারাতের নেতৃত্বে দেশটি এখন নিরাপত্তা, সামাজিক পুনর্গঠন এবং উন্নয়নের জন্য উন্মুক্ত হয়ে উঠেছে।
অসম্ভবকে সম্ভব
আক্তাই মনে করেন, আফগানিস্তানের মতো দীর্ঘ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সাধারণ ক্ষমা বাস্তবায়ন এবং মাদকবিরোধী অভিযানে এমন সাফল্য অর্জন—দুটি ক্ষেত্রই ‘অসম্ভবকে সম্ভব’ করার স্পষ্ট উদাহরণ। তার মতে, এই অভিজ্ঞতা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা, সামাজিক সংহতি এবং সংকট মোকাবিলায় বাস্তব পাঠ হিসেবে স্থান পাওয়ার যোগ্য।
সূত্র : ইয়ানি শাফাক