আজ মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা ও মহান বিপ্লবী শহীদ হাসান আল বান্নার শাহাদাত বার্ষিকী।
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি গুপ্তঘাতকদের হামলায় শাহাদাত বরণ করেছিলেন তিনি।
খেলাফত পরবর্তী ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন মিশরে তার ইসলামী সংস্কারমূলক কার্যক্রম ও সচেতনতা, ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা, মুসলিম বিশ্বে প্রভাব বৃদ্ধির পাশাপাশি গণ-মানুষের নেতা হয়ে উঠা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। খেলাফতের পতন ঘটানো প্রধান শক্তি ব্রিটিশরা তার কর্মকাণ্ড, গ্রহণযোগ্যতা ও প্রভাবের ফলে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলো। শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলো ১৯৩৬-১৯৩৯ এর ফিলিস্তিন বিদ্রোহে জায়োনিস্ট ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তার কৌশলগত রাজনৈতিক ও সশস্ত্র আন্দোলনের কার্যকারিতা দেখে। যে বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটেছিলো সিরিয়া বংশোদ্ভূত ফিলিস্তিনের অন্যতম মহান নেতা শায়েখ ইজ্জুদ্দিন কাসসামের শাহাদাতের মধ্যদিয়ে। যাকে ১৯৩৫ এর শেষদিকে হত্যা করেছিলো জায়নবাদী ব্রিটিশরা। যে বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিলো ফিলিস্তিনে আশ্রিত ইউরোপীয় ইহুদি ও জায়োনিস্টদের জন্য প্রথমাবেরের মতো ব্রিটিশদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ধারণা উপস্থাপন।
হাসান আল বান্না ব্রিটিশ ও পশ্চিমাদের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আরব বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করতে ও তৎকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতায় মুক্তি পেতে প্যান আরব প্যান ইসলামের ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যাকে ইসলামী খেলাফতের আধুনিক রূপ বলা যায়। কেননা এই ধারণার মূল মর্ম হলো, খেলাফত পরবর্তী নতুন বিশ্বে ভূখণ্ড ও দেশ ভিন্ন হলেও সকল আরব এক। পুরো আরব একটি দেশ। বিশ্বের সকল মুসলিম এর জনগণ। মুসলিমরা এক জাতি।
ফিলিস্তিন বিদ্রোহ সফল করতে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে তিনি মুসলিমদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অর্থ সাহায্য ও স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যেতে আগ্রহীদের নিজের সাথে পেয়েছিলেন। এমনকি ১৯৪৭-১৯৪৯ এ সংঘটিত হওয়া আরব-ইসরাইল যুদ্ধে বিভিন্ন ছোট ছোট যোদ্ধা দলও প্রেরণ করেছিলেন।
ফিলিস্তিন ও মিশরে কোনঠাসা হয়ে পড়া ব্রিটিশরা তার সামরিক সক্ষমতার কথা জানতে পেরে তাদের দখলদারিত্বে থাকা মিশরের সরকারকে চাপ দেয়। ফলে মিশরের রাজতন্ত্রের সরকার ও হাসান আল বান্নার দলের মাঝে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে।
কেননা তার দলটি ইতিমধ্যেই বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলো। মিশর সহ আরব বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও সমর্থন লাভ করেছিলো। হাসান আল বান্না ও তার দলের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের ক্ষমতা দখলের অপপ্রচারও মিশর সরকারের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অপরদিকে পশ্চিমা ও ব্রিটিশদের তাবেদারী করায়, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক রুট সুয়েজ খাল সহ মিশরের অর্থনীতি ব্রিটিশদের হাতে সঁপে দেওয়ায় মিশররের নির্যাতিত জনগণ ব্রিটিশ ও মিশরের রাজতন্ত্রের সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপে ছিলো। সময়ে সময়ে প্রচুর বিক্ষোভ ও আন্দোলনের মুখোমুখি হয়ে আসছিলো। পরিস্থিতি যখন এমন, একদিন তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
তার কন্যা ওয়াফা আল বান্নার স্বামী সাঈদ রমাদান যিনি তার শাহাদাতের পর ইখওয়ানের প্রধান হয়েছিলেন, তার বক্তব্য অনুসারে ব্রিটিশদের নির্দেশনায় মিশরের সরকার হাসান আল বান্নাকে হত্যা করেছিলো।
তার বক্তব্য মতে, “মিশরের ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র করছে ইখওয়ান” ব্রিটিশরা যখন এই অপপ্রচার ও গুজব ছড়িয়ে দেয় তখন প্রধানমন্ত্রী নাকরাশী পাশা ১৯৪৮ এর ডিসেম্বরে ইখওয়ানকে অবৈধ সংগঠন ঘোষণা করেন। এর যাবতীয় সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন। দেশজুড়ে ব্যাপক ধরপাকড় চালানো হয়। এর প্রেক্ষিতে এক ছাত্র যে ইখওয়ানেরও সদস্য ছিলো নাকরাশীকে হত্যা করে বসে। যা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। অপরদিকে হাসান বান্না বিষয়টি জানতে পেরে এর নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন। ইসলাম এমন হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে না বলে জানান।
১৯৪৯ এর ফেব্রুয়ারিতে মিশরের রাজতন্ত্রের সরকার গণ-মানুষের অঘোষিত সরকারে পরিণত হওয়া হাসান আল বান্নার সাথে আলাপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আলোচনার স্থান হিসেবে নির্ধারিত হয় কায়রোর জামইয়্যাত আল-শুব্বানুল মুসলিমীনের সদর দপ্তর। ১২ ফেব্রুয়ারি আলোচনার দিন ধার্য্য হয়। হাসান আল বান্না তার শ্যালক আব্দুল করিম মনসুর সহ যথাস্থানে উপস্থিত থাকলেও সেদিন সরকার প্রতিনিধি মন্ত্রী জাকি আলি পাশা আসেননি। বিকাল ৫টায় হাসান আল বান্না চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে যখন সদর দপ্তরের বাইরে এসে দাঁড়ান ও ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিলেন তখন দু’জন বন্দুকধারী তাকে গুলি করে হত্যা করে। রক্তক্ষরণে তিনি শাহাদাতের কোলে ঢলে পড়েন।
এই মহান সমাজ সংস্কারক ও বিপ্লবীর জন্ম মিশরের উত্তরাঞ্চলীয় বাহরিয়া জেলার মাহমুদিয়া শহরে। ১৯০৬ সালের ১৪ অক্টোবর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ৪ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন তিনি। তার পিতার ছিলেন শায়েখ আহমদ আব্দুর রহমান আল বান্না আস-সা’আতী। তিনি মিশরের একজন বিশিষ্ট হাম্বলী ফিকাহ ও হাদিস বিশারদ ছিলেন। তার মায়ের নাম উম্মে সা’আদ।
হাসান আল বান্না তার সামাজিক, রাজনৈতিক ও বিপ্লবী কার্যক্রম বা আন্দোলনকে সুশৃঙ্খল করতে ও লোকজনকে জামায়াত বদ্ধ করতে ১৯২৮ সনে একটি দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটিই হলো ইখওয়ানুল মুসলিমীন যা আরবে ইখওয়ান ও বহির্বিশ্বে মুসলিম ব্রাদারহুড নামে প্রসিদ্ধ।
এর আগে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। ছিলেন মসজিদের ইমাম ও খতিব। মূলত মসজিদের মিম্বার থেকে তার সমাজ সংস্কারের কাজের সূচনা হয়। লেখালেখির মাধ্যমে যা আরো বেগবান হয়। সংস্কার কাজে তিনি তৎকালীন অন্যতম প্রভাবশালী ইসলামী ব্যক্তিত্ব শায়েখ রশিদ রিদা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।