বুধবার, মার্চ ১২, ২০২৫

উত্তর আফ্রিকার সংগ্রামের প্রতীক, যিনি একাকী ও লাঠি দিয়ে হলেও জিহাদ করতে চেয়েছিলেন

একাকী ও লাঠি দিয়ে হলেও উত্তর আফ্রিকায় খেলাফত বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করতে চেয়েছিলেন যিনি সেই সংগ্রামী মুসলিম বীরের ইন্তেকালের ৯২ বছর পার হয়েছে গত ১০ মার্চ সোমবার।

তিনি আর কেউ নন বরং শায়েখ সাইয়েদ আহমদ শরীফ আস-সানুসী, যিনি ১৮৭৩ সনে উসমানী খেলাফতের অধীন লিবিয়ার জাগবুবে বিখ্যাত সানুসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সংগ্রাম ও হিজরতরত অবস্থায় ১৯৩৩ সালের ১০ মার্চ মদিনায় তার তার ইন্তেকাল হয়।

ইসলাম চর্চার সানুসী ধারা প্রতিষ্ঠা ও উত্তর আফ্রিকায় খেলাফত বিরোধী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে সানুসী আন্দোলন শুরুর জন্য তার পরিবার সানুসী নামে বিখ্যাত হয়ে উঠে। সানুসী মূলত শায়েখ সাইয়েদ আহমদ শরীফ আস-সানুসীর দাদা শায়েখ মুহাম্মদ ইবনে আলি আস-সানুসী আল ইদ্রিসীর এক উস্তাদের নাম। যিনি আলজেরিয়ার প্রখ্যাত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার বিশেষ শাগরেদ হওয়ায় সাইয়েদ আহমদ শরীফের দাদাকেও সানুসী ডাকা হতো।

ফ্রান্স বিরোধী জিহাদ ও সানুসী ধারার নেতৃত্ব গ্রহণ:

উত্তর আফ্রিকার সংগ্রামের প্রতীক আহমদ সানুসী ফ্রান্স বিরোধী জিহাদ ও সানুসী ধারার নেতৃত্ব পান এমন নাজুক সময়ে যখন ব্রিটিশ ও ইহুদীবাদীরা খেলাফতের বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছিলো। খেলাফতের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসেছিলো উসমানীয়দের সহায়তায় ইউরোপীয় হায়েনাদের নৃশংস থাবা থেকে সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হওয়া ফ্রান্স। ব্রিটিশদের সাথে করেছিলো একাধিক গোপন চুক্তি।

এমনই উত্তাল সময়ে উত্তর আফ্রিকা দখলে সুদান হয়ে এগিয়ে আসতে থাকা খেলাফত বিরোধী শক্তি ফ্রান্সকে ঠেকাতে চাচা মুহাম্মদ মাহদী আস-সানুসীর সাথে লিবিয়ার কুফরা থেকে বর্তমান আফ্রিকান রাষ্ট্র চাদে গিয়েছিলেন আহমদ সানুসী। যেখানে খেলাফতের পক্ষে ১৮৯৯-১৯০৯ পর্যন্ত ফ্রান্স বিরোধী সংগ্রাম ও জিহাদে নেতৃত্ব দিয়েছিলো সানুসীরা।

১৯০২ সালের ১ জুন ইন্তেকালের সময় চাচা মাহদি ভাতিজা আহমদ সানুসীর হাতে চাদে ফ্রান্স বিরোধী জিহাদ ও সানুসী ধারার নেতৃত্বের দায়িত্ব দিয়ে যান। ফলে ১৯০২ থেকে সানুসীদের সরাসরি নেতৃত্বে আসেন তিনি। কিন্তু তার নেতৃত্ব চাদে ফ্রান্সের প্রবেশ ও দখল ঠেকাতে ব্যর্থ হয়। ১৯০৯ সালে সুদান হয়ে চাদের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয় ফ্রান্স।

লিবিয়ায় ইতালি বিরোধী জিহাদ:

উসমানীয়দের সাথে চুক্তিবদ্ধ ইতালি যখন ১৯১১ সালে বিশ্বাসঘাতকতা পূর্বক লিবিয়া আক্রমণ করে বসে তখন আহমদ সানুসী স্থানীয়দের সংঘবদ্ধ করতে ও কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাদ থেকে দেশে ফিরে আসেন।

কেননা লিবিয়ায় থাকা খেলাফত বাহিনী তখন অবস্থান করছিলো ইয়েমেনে। কায়রো চলে গিয়েছিলো ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে। অপরদিকে ফ্রান্সও তিউনিসিয়া-আলজেরিয়ার বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খেলাফতের বাহিনীর আগমনের পথ কঠিন করে তুলেছিলো। কায়রোর উপর ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হওয়ায় সাগর পথেও বাহিনী পাঠানো ছিলো কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

এটি সেই যুদ্ধ যেখানে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পর্যবেক্ষণ বিমান আকাশে উড়তে দেখা যায়। প্রথমবারের মতো বিমান থেকে বোমা নিক্ষিপ্ত হয় এবং প্রথমবারের মতো উসমানীয়রা বিমান ভূপাতিত করে। আকাশ ও সাগর থেকে একসাথে স্থলে হামলা চালানো হয়। যে যুদ্ধের স্থায়িত্ব ছিলো প্রায় ১ বছর। (২৯ সেপ্টেম্বর ১৯১১ – ১৮ অক্টোবর ১৯১২)

এই যুদ্ধ থেকেই ইউরোপীয়রা প্রথমবারের মতো উসমানীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সাহস পেয়েছিলো। ইতালির কাছে রোডস সহ আজিয়ান ও পূর্ব-ভূমধ্যসাগরের গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলো উসমানী খেলাফত। লিবিয়া যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই শুরু হয়েছিলো বলকান যুদ্ধ বা বিদ্রোহ। যার সূত্রে পরবর্তীতে সংঘটিত হয়েছিলো ১ম বিশ্বযুদ্ধ।

লিবিয়ার দিরনায় ইতালির বিরুদ্ধে জিহাদ বা যুদ্ধটি ছিলো আহমদ সানুসীর প্রথম বড় ধরণের যুদ্ধ, যেখানে তিনি খেলাফত বাহিনীর সাথে একত্রে লড়াই করেছিলেন। পাশে পেয়েছিলেন আনোয়ার, ফাতিহ, মোস্তফা কামাল, জাভেদ আব্বাস, ফুয়াদ বুলচা ও সুলাইমান আসকারীর মতো প্রসিদ্ধ উসমানী পাশা ও অফিসারদের। প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও সেনাদের নিয়ে গোপনে ছদ্ম পরিচয়ে লিবিয়ায় পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন তারা।

খেলাফতের পক্ষ থেকে সম্মাননা:

শায়েখ আহমদ সানুসীর অনবদ্য নেতৃত্বের ফলে লিবিয়ার দিরনা সহ বেশ কয়েকটি যুদ্ধে চরম বিপর্যয়ে পড়েছিলো ইতালি। ভরাডুবি ঘটেছিলো তাদের বাহিনীর। একারণে তাকে খেলাফতের পক্ষ থেকে প্রথম শ্রেণীর উসমানী পদক নিশানে ইমতিয়াজ দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিলো। পরবর্তীতে প্রেরণ করা হয়েছিলো নগদ অর্থ, মূল্যবান পাথর বিশিষ্ট তরবারি, বিশেষ হাত ঘড়ি ও জায়নামাজ।

দরদী ও দূরদর্শী সুলতান আব্দুল হামিদ সানীর প্রভাব ও সানুসী ধারার পুনরুজ্জীবন:

লিবিয়া যুদ্ধে খেলাফতের মসনদে সুলতান মেহমেদ পঞ্চম থাকলেও বহু আগ থেকেই উত্তর আফ্রিকার স্থানীয়দের সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন মূলত উম্মাহ দরদী ও দূরদর্শী শেষ ক্ষমতাবান সুলতান, সুলতান আব্দুল হামিদ সানী। তার প্রচেষ্টার জেরেই সানুসীরা স্থানীয়দের বাহিনী গঠন করে ফ্রান্স, ইতালি ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলো বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। এক পর্যায়ে যে বাহিনীর নেতৃত্বে এসেছিলেন মরু সিংহ খ্যাত ইতালির যম শহীদ ওমর মুখতার।

শায়েখ আহমদ সানুসী তার বাবা ও চাচার সাথে থাকার সুবাদে লিবিয়ার গুরুত্ব খুব ভালোভাবেই জানতে পেরেছিলেন, যারা পর্যায়ক্রমে সানুসী ধারার নেতৃত্বে ছিলেন। আব্দুল হামিদ সানী যাদের কাছে উত্তর আফ্রিকা ও লিবিয়ার গুরুত্ব তুলে ধরে সংঘটিত হওয়ার বার্তা পাঠিয়েছিলেন।

১৯১১ তে তাই চাদ থেকে লিবিয়া ফিরেই প্রথমে সকল ওলামা ও গোষ্ঠী প্রধানদের একত্র করেছিলেন এবং গোষ্ঠীগত পুরোনো শত্রুতা থাকা সত্ত্বেও উত্তর আফ্রিকার সকলকে যুদ্ধের জন্য ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

সানুসীর ঐতিহাসিক ভাষণ:

শায়েখ আহমদ সানুসী, সানুসী ধারা পুনরুজ্জীবিত করতে আগ থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এছাড়া গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব বাদ দিয়ে উত্তর আফ্রিকার সকলকে জিহাদের জন্য ঐক্যবদ্ধ করতে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। এমনকি যারা সানুসী ধারা ও আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন সেসব স্থানীয় শক্তিকেও তিনি ইতালির বিরুদ্ধে জিহাদে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, মহান আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, একাকী ও লাঠি দিয়ে হলেও আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করবো।

তার ভাষণ উত্তর আফ্রিকার গোত্র ও স্থানীয়দের মাঝে আগুন প্রজ্বলিত করতে সক্ষম হয়েছিলো। এমনকি চাদ, নাইজার, সুদান, সোমালিয়া ও মরক্কো থেকেও বহু মুসলিম ও গোষ্ঠী সামরিক সহযোগিতার জন্য এসেছিলো।

১৯১১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯১২ এর ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ইতালির বিরুদ্ধে বহু যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় খেলাফত ও মুসলিম বাহিনী। বিশেষত স্থানীয় মুসলিম বাহিনী ৪টি শিবির স্থাপন করেছিলো এবং ইতালির নাভিশ্বাস তুলে ছেড়েছিলো। ১২ এর অধিক যুদ্ধে তাদের নাকানিচুবানি খাইয়ে ছিলো সানুসীর অধীনে ঐক্যবদ্ধ হওয়া মুসলিম বাহিনী। তন্মধ্যে ত্রিপোলির যুদ্ধ, দিরনার যুদ্ধ, আল খুমসের যুদ্ধ, কারকারশের যুদ্ধ ও আবু কামাশের যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

spot_imgspot_img

সর্বশেষ

spot_img
spot_img
spot_img
spot_img