জুনাইদ আহমদ
যুগের বান্নুরী আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রহিমাহুল্লাহু। পুরো হায়াতের অর্ধেকেরও বেশি সময় ব্যয় করেছেন হাদীসে রাসূলের খেদমতে। দারুল উলুম হাটহাজারীতে শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুল কাইয়ুম (রহ.) এবং করাচি বান্নুরী টাউনে বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসুফ বান্নুরী (রহ.) এর নিকট হাদীসের পাঠগ্রহণ শেষে নানা আরেফ বিল্লাহ আল্লামা হারুন বাবুনগরী (রহ.) এর প্রতিষ্ঠিত জামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগর মাদরাসায় হাদীসের খেদমতের মাধ্যমে হযরত কর্মজীবনের শুভ সূচনা করেন।
বাবুনগর মাদরাসায় দীর্ঘ ২৪ বছর হাদীসের খেদমত করার পর ২০০৩ সন থেকে ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত উম্মুল মাদারিস দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে হাদীসের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত এ হাদীস বিশারদ।
দারুল উলুম হাটহাজারীতে সহিহ মুসলিম শরীফ, তিরমিজি শরীফ,মুয়াত্তা, মিশকাত শরীফ সহ বুখারী শরীফের পাঠদান করেছেন। তিনি হাটহাজারী মাদরাসার শায়খুল হাদীস ছিলেন। আসরের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত, দরসে যাওয়ার আগে, রাতে এবং দিনের বিভিন্ন সময়ে নির্ভরযোগ্য শরুহাত (ব্যখ্যাগ্রন্থ) সহ হাদীসের কিতাব মোতালায়া করতেন তিনি।
আসরের পর থেকে মাগরিব- এই সময়ে খুব গুরুত্বের সাথে মোতালায়া করতেন। মোতালায়ার সময় কেহ হযরতের রুমে ঢুকা পছন্দ করতেন না। এমনকি আমরা খাদেমরাও তখন একান্ত কোন কাজে হযরতের মোতালায়ার কামরায় যাওয়াটা পছন্দ করতেন না। একাগ্রতার সাথে খুব মনোযোগী হয়ে হযরত মোতালায়া করতেন। মোতালায়ার সময় শুধু হাদীসের কিতাব বা শরুহাতই নয় উলূমুল হাদীসের কিতাবাদী সহ আনুষাঙ্গিক বহু কিতাব হযরতের মোতালায়ার টেবিলে থাকতো।
মোতালায়ার সময় হযরতের একাগ্রতা আর মনোযোগ এতো বেশি ছিলো যে, মাঝেমধ্যে দীর্ঘক্ষণ মোতালায়ার পর শরীরে ক্লান্তি আসলে আমাদেরকে বলতেন- এক কাপ রং চা- দাও তো। আমরা চা-বানিয়ে টেবিলে রেখে চলে আসতাম। পরে গিয়ে দেখতাম মোতালায়ায় বেশি মনোযোগী হওয়ার কারণে হযরত চা- খাওয়ার কথা ভুলে গেছেন। আমরা যদি জিজ্ঞাসা করতাম, হযরত! চা- তো ঠান্ডা হয়ে গেলো, আপনি খেলেন না। জবাবে বলতেন- ওহহো… আমি তো ভুলে গেছি। আচ্ছা! এখন রাখো মিয়া,পরে খাবো।
মোতালায়ার সময় মাঝেমধ্যে দূরদূরান্ত থেকে বিশেষ কোন মেহমান চলে আসলে হযরতকে গিয়ে বলা হতো যে,অনেক দূর থেকে কিছু মেহমান এসেছেন। একটু সাক্ষাৎ চাচ্ছেন। মোতালায়া শুরুর পর অন্যান্য কাজ থেকে হযরত এতোটাই বেখবর হতেন যে, কানের কাছে গিয়ে একটা কথা কয়েকবার বলার পরও হযরত যেন শুনতে পেতেন না। বেশ কয়েকবার বলার পর, বলতেন- ও মিয়া! কে আসছে এখন? এখন তো আমার মোতালায়ার সময়, এটা মেহমানদেরকে বলোনি? আচ্ছা, জলদি আসতে বলো। এখন তো সালাম, মোসাফাহা ছাড়া অতিরিক্ত কোন কথা বলতে পারবো না।
মোতালায়ার সময় হযরত কিতাবের মতনের (মূলপাঠের) সাথে সাথে কিতাবের ডানে-বামে ও উপরে-নিচে থাকা হাওয়াশী ( টীকাটিপ্পনী) ইত্যাদিও খুব মনোযোগ সহকারে পড়তেন, মাঝেমধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হাশিয়াতে (টীকায়) কলম দিয়ে দাগ দিতেন। হাশিয়ার পাশে নিজের পক্ষ থেকেও কিছু সংযোজন করতেন, লিখতেন।
মোতালায়ার সময় হযরতের একটা বিষয়টা খুব লক্ষণীয় ছিলো, তা হলো- দীর্ঘক্ষণ মোতালায়ার পর হযরত কিছু সময় চোখ বন্ধ করে রাখতেন। ঠোঁট নাড়িয়ে নাড়িয়ে মুখস্থ পড়তেন।
এরপর আবার চোখ খোলে পড়া শুরু করতেন । মনে হতো – এতোক্ষণ যা মোতালায়া করেছেন সব যেন জেহেনে (স্মৃতিতে) বসিয়ে নিয়েছেন।
শায়খুল হাদীস মনোনিত হওয়ার আগে বাদ মাগরিব বুখারী শরীফের দরস দিতেন। আসরের পর থেকে মোতালায়া করতেন, মাগরিবের আজান হওয়ার সাথে সাথে জামাত সহকারে নামাজ আদায় করে নিতেন। সুন্নাত, আওয়াবিন শেষ করে আরো কিছু সময় কিতাবে (যতটুকু সবক পড়াবেন) চোখ বুলাতেন। এরপর বলতেন দাওরার ছাত্ররা আসলে দরসগাহে কিতাব পাঠিয়ে দিও।
হাদীসের দরসে যাওয়ার আগে হযরত খুব ভালোভাবে আতর সুগন্ধি মাখতেন। মাথায় গাগড়ী বাঁধতেন। অনেকটা সাজসজ্জা ও পরিপাটি হয়ে দরসের উদ্দেশ্যে হুইলচেয়ারে বসতেন। ছাত্ররা রুমের বাইরে হুইলচেয়ার রেডি করে অপেক্ষমাণ থাকতো। হযরত নিজ কামরা থেকে বের হয়ে প্রথমে ছাত্রদেরকে সালাম দিতেন। দরসগাহে উপস্থিত হয়েও প্রথমে সবাইকে সালাম দিতেন।
অত্যন্ত খোশমেজাজ নিয়ে হযরত হাদীস পড়াতেন। মাথায় পাগড়ী আর শরীর থেকে আসা আতরের মৌ মৌ গন্ধে যেন পুরো দরস বিমোহিত হতো। হযরতের চেহারা এমনিতেই সুন্দর ও মায়াবী ছিলো।
যখন হাদীসের দরসে বসতেন তখন যেন আলাদা রকম নূরের একটা ঝলক পরিলক্ষিত হতো। একের পর এক হাদীস পড়া হতো আর হযরত তাকরীর করতেন। কানায় কানায় ভরপুর পুরো দরস যেন তখন- ” ও বিহী ক্বলা হাদ্দাসানার” সুমধুর সুরে উদ্বেলিত হতো।
ওজু ছাড়া হযরত কখনো হাদীসের দরসে যেতেন না। জীবনের শেষ সময়ে শারীরিক অসুস্থতার কারণে নিজে নিজে ওজু করতে পারতেন না। ওজু করতে বেশ কষ্ট হতো। এরপরও বহু সময় দেখেছি- শুধু হাদীসের দরসে যাওয়ার জন্যই হযরত ওজু করে নিতেন।
আল্লাহ তায়া’লা হযরতকে জান্নাতে উঁচু মাকাম দান করুন আমিন।
সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী, আল্লামা বাবুনগরী (রহ.)