ইহুদিবাদী সন্ত্রাসীদের অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল এখন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আন্তর্জাতিক মতৈক্যের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া কিংবা ক্রমবর্ধমান একঘরে অবস্থান এবং বাস্তবিকভাবে নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি। দীর্ঘদিন ধরে চ্যালেঞ্জের মুখে থাকলেও দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই এখনো একমাত্র কার্যকর শান্তির পথ।
ফ্রান্স ও ব্রিটেনের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি আন্তর্জাতিক পরিসরে সেই মতৈক্যকে আরও জোরদার করছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির জন্য দুই রাষ্ট্র সমাধানই একমাত্র কার্যকর পথ, এবং এর বৈশ্বিক প্রভাব রয়েছে। যদিও স্বীকৃতি প্রদানই দখলদারিত্বের বাস্তবতা বদলে দেবে না, তবুও এর গভীর আইনগত ও রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে। এটি ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি দেয় এবং ইসরাইলকে স্পষ্ট বার্তা পাঠায় যে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অস্বীকৃতি আন্তর্জাতিক আইন ও বিদ্যমান বৈশ্বিক মতৈক্যের পরিপন্থী এবং অটেকসই।
ইউরোপ জুড়ে এই পদক্ষেপ বৃহত্তর প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ইসরাইলের অব্যাহত দখলদারিত্ব, বসতি সম্প্রসারণ এবং কার্যকর আলোচনায় অস্বীকৃতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে অনেক দেশ তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করেছে। স্বীকৃতির প্রতীকী ও আইনি প্রভাবকে ছোট করে দেখা যাবে না। এটি ফিলিস্তিনের আন্তর্জাতিক আইনি মর্যাদাকে আরও শক্তিশালী করে এবং ইসরাইলের দখলদারিত্বকে চ্যালেঞ্জ জানায়, যা আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ২০০৪ এবং ২০২৪ সালের দুইটি পরামর্শমূলক মতামতে “অবৈধ” ঘোষণা করেছে।
আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃতির মানে কী?
আন্তর্জাতিক আইনে কোনো রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া হলো একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ, যা মন্টেভিদিও কনভেনশন (১৯৩৩)–এর ১নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত মানদণ্ড অনুযায়ী রাষ্ট্রের মর্যাদা স্বীকার করে: একটি স্থায়ী জনসংখ্যা, সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সক্ষমতা। যদিও দখলদারিত্বের কারণে ফিলিস্তিনের ভৌগোলিক বিভাজন পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র পরিচালনায় জটিলতা তৈরি করে, ইতিমধ্যেই জাতিসংঘের ১৪৮টি সদস্য রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা তার সার্বভৌমত্বের বৈধতাকে নিশ্চিত করে।
অবশ্যই, স্বীকৃতি ইসরাইলি দখলদারিত্ব শেষ করে না বা সীমানা নির্ধারণের মতো প্রশ্ন মেটায় না। তবে এটি ফিলিস্তিনের আন্তর্জাতিক ফোরাম ও আইনগত বিরোধে অবস্থানকে শক্তিশালী করে। একইসঙ্গে ইসরাইলকে বার্তা দেয় যে, তাদের বর্তমান নীতি, বসতি সম্প্রসারণ, সংযুক্তিকরণের হুমকি এবং আন্তরিক আলোচনায় অস্বীকৃতি, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে অসঙ্গত এবং এর ফলে নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে পারে।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বারবার ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং দখলদারিত্ব সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে। বর্তমানে আইসিজে দুটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি করছে: দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম ইসরাইল, যেখানে মানবাধিকার ও মানবিক আইন লঙ্ঘনের মাত্রা, এমনকি ১৯৫১ সালের গণহত্যা প্রতিরোধ ও শাস্তি কনভেনশনের অভিযোগও বিবেচনায় রয়েছে; আরেকটি হলো ইসরাইলের জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর (যেমন: ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ) প্রতি আইনি বাধ্যবাধকতা সম্পর্কিত পরামর্শমূলক মতামত। পশ্চিমা ও ইউরোপীয় দেশগুলোর নতুন স্বীকৃতি এই আইনি অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে এবং আন্তর্জাতিক আইনে ইসরাইলের নীতিকে আরও একঘরে করে তুলবে।
কসোভোর স্বাধীনতা: স্বীকৃতি কীভাবে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে প্রভাবিত করে
কসোভোর উদাহরণ এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সার্বিয়ার তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতির ফলে কসোভো তার কার্যত রাষ্ট্রীয় মর্যাদা সুসংহত করেছে, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে অংশ নিয়েছে এবং এমন আইনগত নজির তৈরি করেছে যা সার্বিয়া আর বদলাতে পারছে না। যদিও কসোভোর স্বাধীনতা এখনো বিতর্কিত, কারণ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্য রাশিয়া ও চীন এর বিরোধিতা করে, তবুও বাস্তবে স্বীকৃতির মাধ্যমে এর সার্বভৌমত্ব স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
একইভাবে, ফিলিস্তিনের ব্যাপক স্বীকৃতি তার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি দৃঢ় করবে এবং ইসরাইলের পক্ষে অর্থবহ আলোচনায় অংশগ্রহণ না করার অবস্থানকে ক্রমশ অসহনীয় করে তুলবে। কসোভোর মতোই ফিলিস্তিন হয়তো জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ পাবে না, কারণ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতা আছে। তবে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর কূটনৈতিক স্বীকৃতি ভবিষ্যতের আলোচনায় ফিলিস্তিনকে বাড়তি প্রভাব দেবে।
পশ্চিমা মতৈক্যের বিস্তার
ফ্রান্স ও ব্রিটেনের পাশাপাশি পর্তুগাল, মাল্টা, সান মারিনো ও ফিনল্যান্ডও স্বীকৃতির পথে এগোচ্ছে। ইতোমধ্যে স্পেন, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, স্লোভেনিয়া ও বেলজিয়াম এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এমনকি কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো ঐতিহ্যগতভাবে সতর্ক দেশও তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনার ইঙ্গিত দিয়েছে। এ ধারা স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, ইসরাইলের দুই রাষ্ট্র সমাধান অস্বীকার এবং বসতি সম্প্রসারণ আন্তর্জাতিকভাবে গভীর হতাশা তৈরি করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধীরে ধীরে ফিলিস্তিন স্বীকৃতির দিকে ঝোঁকা প্রমাণ করছে যে বর্তমান অবস্থা অবিরাম দখল, বসতি সম্প্রসারণ এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য রাজনৈতিক দিগন্তের অনুপস্থিতি অটেকসই।
ইসরাইলের প্রতি বার্তা: স্বীকৃতি কূটনৈতিক বাস্তবতা যাচাই
স্বীকৃতিকে ইসরাইল-বিরোধী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা উচিত নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি পুনরায় আনুগত্যের ঘোষণা। ওসলো চুক্তি মূলত একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু তিন দশক পেরিয়ে গেলেও ইসরাইল সামরিক নিয়ন্ত্রণ, বসতি সম্প্রসারণ এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের বিভাজনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করেছে। ইউরোপীয় দেশগুলো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়ে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ইসরাইল অনন্তকাল ধরে শর্ত চাপিয়ে যেতে পারবে না।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বৈশ্বিক শক্তিগুলো যে কাঠামো অনুমোদন করেছে, সেটি হলো দুই রাষ্ট্র সমাধান। স্বীকৃতি আলোচনার বিকল্প নয়, বরং তার জরুরিতা আরও বাড়িয়ে তোলে। ইসরাইল যদি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে অস্বীকার করতে থাকে, তবে তা আরও কূটনৈতিক একঘরে হয়ে পড়বে এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে নিজের বৈধতাও ক্ষুণ্ন করবে। তাই এই স্বীকৃতি শক্ত বার্তা দেয়: ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কোনো ছাড় নয়, বরং একটি অধিকার। কসোভোর মতোই আন্তর্জাতিক মতৈক্য বাস্তবতাকে গড়ে তুলতে পারে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইসরাইলকে স্বীকার করতে হবে যে অস্বীকার আর কোনো বিকল্প নয়।
শান্তির মোড় ঘোরানো মুহূর্ত
ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রের প্রত্যাশিত স্বীকৃতি এই সংঘাতের কূটনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক মোড় ঘোরানো মুহূর্ত হয়ে উঠতে পারে। যদিও এটি তাৎক্ষণিকভাবে দখলদারিত্ব শেষ করবে না বা সব বিরোধ মেটাবে না, তবে এটি আবারও ঘোষণা করে যে ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অলোচনাযোগ্য নয়।
ইসরাইল এখন এক পছন্দের সামনে: পরিবর্তিত বৈশ্বিক মতৈক্যের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো অথবা ক্রমবর্ধমান একঘরে অবস্থা ও সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হওয়া। চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই শান্তির একমাত্র কার্যকর পথ। স্বীকৃতি কোনো প্রক্রিয়ার সমাপ্তি নয়, বরং জাতিসংঘ সনদের অধীনে ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই শান্তির দিকে এটি একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ।
সূত্র: ইয়ানি সাফাক











