ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের একাধিক কর্মী অভিযোগ করেছেন, সংস্থার সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনায় ইসরাইলপন্থী পক্ষপাত লক্ষ্য করা যায়।
বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তারা নিজেদের অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
সাংবাদিক আনাস আল-শরীফ হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে বিতর্ক
সম্প্রতি ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আনাস আল-শরীফকে ইসরাইল হত্যার পর রয়টার্সের কাভারেজে নতুন করে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। আল-শরীফ পূর্বে রয়টার্সে কাজ করেছেন এবং ২০২৪ সালে এখানে কাজের জন্য পুলিৎজার পুরস্কারও জিতেছেন। কিন্তু তার মৃত্যুর খবর প্রকাশে রয়টার্স শিরোনাম দেয়, ইসরাইল কিলস আল-জাজিরা জার্নালিস্ট ইট সেস ওয়াস হামাস লিডার অর্থাৎ ইসরাইল আল-জাজিরার এক সাংবাদিককে হত্যা করেছে, আর ইসরাইল দাবি করছে তিনি হামাসের নেতা ছিলেন।
এই পক্ষপাতদুষ্ট উপস্থাপন শুধু সাধারণ পাঠকের মধ্যে নয়, রয়টার্সের অভ্যন্তরেও ক্ষোভ সৃষ্টি করে। ফলে সংস্থার ভেতরে বিষয়টি নিয়ে পক্ষপাতবিষয়ক একটি পর্যালোচনা শুরু হয়।
অভ্যন্তরীণ তদন্তের ফলাফল
ডিক্লাসিফায়েড ইউকে নামের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার গ্রুপ জানায়, রয়টার্স সাংবাদিকদের এক অভ্যন্তরীণ গবেষণায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত ৪৯৯টি “ইসরাইল-ফিলিস্তিন” ট্যাগযুক্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করা হয়। এতে দেখা যায়, ফিলিস্তিনিদের তুলনায় ইসরাইলি বিষয়ক সংবাদে ধারাবাহিকভাবে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
একজন রয়টার্স সাংবাদিক ডিক্লাসিফায়েড ইউকে-কে জানান, “একটি বিস্তৃত অভ্যন্তরীণ তদন্ত করা হয়, যেখানে আমাদের প্রতিবেদনের পরিমাণগত ও গুণগত বিশ্লেষণ করা হয়। ৭ অক্টোবরের ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পরই কয়েকজন সাংবাদিক বুঝতে পারেন যে ইসরাইল-গাজ্জা যুদ্ধ নিয়ে আমাদের কাভারেজে বস্তুনিষ্ঠতার অভাব রয়েছে।”
এই অনুসন্ধানের ভিত্তিতেই একটি উন্মুক্ত চিঠি তৈরি হয়, যা নিউজরুমের ভেতরে শেয়ার করে সাংবাদিকদের যুক্ত করা হয়, যেন গাজ্জা সংক্রান্ত সাংবাদিকতায় মানোন্নয়ন আনা যায়।
চিঠির লেখকরা অভিযোগ করেন, “আমাদের পক্ষপাতের একটি স্পষ্ট উদাহরণ হলো ফিলিস্তিন শব্দ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা। কিছু পশ্চিমা দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি নাও দিতে পারে, কিন্তু তাই বলে আমাদের এমন ভান করার প্রয়োজন নেই যে এটি কোনো বাস্তব জায়গা নয়।”
গণহত্যার প্রসঙ্গ ও দ্বৈত মানদণ্ডের অভিযোগ
লেখকরা প্রশ্ন তোলেন, বিশেষজ্ঞরা গাজ্জায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুললেও কেন সেগুলো পর্যাপ্ত গুরুত্ব পায়নি? অথচ রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনে এমন অভিযোগগুলো বারবার গুরুত্ব পেয়েছে।
এ বিষয়ে রয়টার্সের গ্লোবাল নিউজ ডেস্কের কোয়ালিটি অ্যান্ড স্টাইল সম্পাদক হাওয়ার্ড এস. গলার ইমেইলে একটি নীতিমালা হালনাগাদ করেন। সে হালনাগাদের শিরোনাম ছিল, রয়টার্স স্টাইল আপডেট ও কনফ্লিক্ট ইন টি মিডল ইস্ট অর্থাৎ, রয়টার্স নিউজ এজেন্সি তাদের প্রতিবেদনের শৈলী বা “স্টাইল” সংক্রান্ত নতুন নির্দেশিকা বা আপডেট প্রকাশ করেছে, বিশেষভাবে মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত সম্পর্কিত প্রতিবেদনের জন্য।
নতুন নীতিমালা অনুযায়ী সাংবাদিকরা গণহত্যা শব্দ ব্যবহার করতে পারেন, তবে অবশ্যই সূত্র উল্লেখ করে। তবে ফিলিস্তিন শব্দ ব্যবহার সীমিত করে দেওয়া হয় “খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ঐতিহাসিক প্রসঙ্গে”।
তবুও ডিক্লাসিফায়েড ইউকের বিশ্লেষণে উঠে আসে, ২১ জুন থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত প্রকাশিত ৩০০ প্রতিবেদনের মধ্যে মাত্র ১৪টিতে ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আর সেগুলোতেও প্রায়শই ইসরাইলের অস্বীকার যুক্ত করা হয়েছে, যা সুদানের রেপিড সাপোর্ট ফোর্সেস বা রাশিয়ার ক্ষেত্রেও কখনো করা হয়নি।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক আসাল রাদ বলেন, “রয়টার্সের এই ধারা আসলে গণহত্যা অস্বীকারের সমান। তারা গাজ্জায় ইসরাইলের নৃশংসতাকে সবসময় যুদ্ধ বা সামরিক অভিযান হিসেবে উপস্থাপন করছে, অথচ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ঐকমত্য হলো, ইসরাইল গণহত্যা চালাচ্ছে।”
সম্পাদকীয় বাদ দেওয়া ও অসম্পূর্ণতা
ডিক্লাসিফায়েড ইউকের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গলারের পাঠানো ইমেইলে যে “গাজ্জা যুদ্ধ (২০২৩) ও বিস্তৃত প্রসঙ্গ গাইডলাইন কোট করা হয়েছে, সেখানে মূলত ইসরাইলকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। আমেরিকা ও ইসরাইলের ভূমিকা, অবৈধ দখলদারিত্ব, বর্ণবৈষম্য নীতি কিংবা ফিলিস্তিনে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ এসব গুরুত্বপূর্ণ দিক অনুপস্থিত ছিল।
এছাড়া আপডেটেড গাইডলাইনে উল্লেখ করা হয়নি দ্য ল্যানসেট সাময়িকীর গবেষণা (বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী), যেখানে বলা হয়েছে “গাজ্জা যুদ্ধের কারণে ১ লাখ ৮৬ হাজার বা তারও বেশি মানুষের মৃত্যু হতে পারে।” সাংবাদিকদের জন্য গাজ্জা কতটা প্রাণঘাতী এলাকা হয়ে উঠেছে, তাও বাদ পড়ে যায়।
রয়টার্সের প্রতিক্রিয়া
এসব অভিযোগের জবাবে রয়টার্সের এক মুখপাত্র ডিক্লাসিফায়েড ইউকে-কে বলেন—
“আমরা বিশ্বাস করি আমাদের কাভারেজ ন্যায়সঙ্গত ও নিরপেক্ষ, যা থমসন রয়টার্স ট্রাস্ট প্রিন্সিপলস অনুযায়ী পরিচালিত। অন্যান্য অনেক নিউজরুমের মতোই আমাদের কাভারেজও নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করা হয়েছে, এমনকি আমাদের নিজস্ব সাংবাদিকদের দ্বারাও। আমরা বিভিন্ন দিক থেকে প্রতিক্রিয়া পেয়েছি।”
তবে রয়টার্স ম্যানেজমেন্ট এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি যে, অভ্যন্তরীণ গবেষণা থেকে পাওয়া সুপারিশগুলো কার্যকর করা হয়েছে কি না।
সূত্র: আনাদোলু









