চীন ও জাপানের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো গভীর করছে সৌদি আরব।
মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) আরব নিউজের এক প্রতিবেদনে একথা জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন ও জাপানের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো গভীর করছে সৌদি আরব। শিল্প ও বিনিয়োগ অংশীদারিত্বকে আরও এগিয়ে নিতে দেশ দুটিতে দুটি পৃথক সফরে রয়েছে আরব রাষ্ট্রটির উচ্চপর্যায়ের মন্ত্রিসভা। যার অন্যতম লক্ষ্য কৌশলগত সহযোগিতা বিস্তৃত করা, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো।
বেইজিংয়ে সৌদির শিল্প ও খনিজ সম্পদমন্ত্রী বান্দার আল খুরাইফ রাষ্ট্র-সমর্থিত উদ্ভাবন প্ল্যাটফর্ম জেডজিসি (ZGC) গ্রুপের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এতে উন্নত ম্যানুফ্যাকচারিং, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, স্মার্ট মোবিলিটি এবং মহাকাশ প্রযুক্তিতে সহযোগিতার সম্ভাবনা নিয়ে পর্যালোচনা হয়।
আলোচনায় রিয়াদে জেডজিসি (ZGC) এর কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনাও অন্তর্ভুক্ত ছিলো, যা জাতীয় শিল্প উন্নয়ন ও লজিস্টিকস প্রোগ্রামের (NIDLP) সঙ্গে অংশীদারিত্বে কার্যকর হবে।
এই উদ্যোগগুলো সৌদি–চীন অর্থনৈতিক সম্পর্কের গভীরতাকে আরও শক্তিশালী করছে। কারণ, চীন হলো সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। মে মাসের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীন সৌদি আরবের মোট রপ্তানির ১৪ শতাংশ এবং আমদানির ২৮.৯ শতাংশের অংশীদার।
আল খুরাইফের সরকারি সফর ২২ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে। এ সময় তিনি চীনের প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রী, শিল্প ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী, জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ তদারকি ও প্রশাসন কমিশনের চেয়ারম্যানসহ উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
এছাড়াও তিনি BOE, Kyland, TBEA, Ganfeng Lithium, China Minmetals Corporation এবং Gotion Hi-tech এর মতো শীর্ষস্থানীয় শিল্প ও খনন কোম্পানির নির্বাহীদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন। এতে সৌদিতে চীনা প্রযুক্তি স্থানান্তর, উন্নত ম্যানুফ্যাকচারিং সক্ষমতা ও সৌদি আরবে বিনিয়োগের সুযোগের উপর জোর দেওয়া হবে।
এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে, সৌদি শিল্প ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় খনন খাতে সহযোগিতা জোরদারের লক্ষ্যে চায়না মাইনিং অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে একটি কর্মপরিকল্পনা স্বাক্ষর করবে।
এই উদ্যোগের আওতায় সংশ্লিষ্ট জ্ঞান বিনিময়, খনিজ সম্পদ চিহ্নিতকরণ এবং সৌদি খননশিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার নতুন প্রচেষ্টা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। কেননা খনিজ খাত সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০-এর মূল অংশের অন্তর্ভুক্ত।
এছাড়া নভেম্বরে সাংহাইয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া চায়না ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফেয়ারে সৌদি আরব অতিথি দেশ হিসেবে অংশগ্রহণ করবে। সেখানে দেশটি তার শিল্প রূপান্তর কর্মসূচি উপস্থাপন করবে এবং চীনা অংশীদারদের সঙ্গে সহযোগিতার সুযোগ তুলে ধরবে।
ZGC প্রথমদিনের বৈঠকে সৌদি মন্ত্রীকে নিজেদের প্রধান কারখানা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিস্তারিত উপস্থাপন করেছে। এতে রিয়াদে উপস্থিতির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠান স্থাপনের লক্ষ্যও অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
মন্ত্রণালয় তার সরকারি এক্স একাউন্টে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে, এই সফরের লক্ষ্য হলো, দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব বিস্তৃত করা, উচ্চমানের বিনিয়োগ আকর্ষণ করা এবং শিল্প ও খনিজ খাতের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সৌদিতে স্থানান্তর করা।
সৌদি মন্ত্রী ZGC-এর একাধিক সহযোগী প্রতিষ্ঠানেও সফর করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে:
FlightWin যা হেলিকপ্টার ও ড্রোন উৎপাদনে খুবই পারদর্শী।
UISEE যা বিমানবন্দর ও লজিস্টিকস খাতে ব্যবহৃত স্বয়ংক্রিয় যানবাহন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান।
China Power Energy Storage Energy যা জ্বালানি সঞ্চয় ও সমন্বিত নবায়নযোগ্য শক্তি সিস্টেমের উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠান।
সৌদির NIDLP এর সহযোগিতায় রিয়াদে প্রবেশ চীনের ZGC গ্রুপটিকে আরো প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। গ্রুপটি “আইডিয়া–আইপি–ইন্ডাস্ট্রি–আইপিও” চেইনের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোকে সমর্থন করে, যা সৌদি আরবে উন্নত ম্যানুফ্যাকচারিং ও গবেষণা–উন্নয়নের স্থানীয়করণের জন্য একটি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে।
FlightWin ও UISEE-এর মতো সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি ভিশন ২০৩০-এর লক্ষ্য পূরণের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। FlightWin-এর হেলিকপ্টার ও মানববিহীন উড়োজাহাজ প্রযুক্তি সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা ক্রয়ের ৫০ শতাংশ স্থানীয়করণের লক্ষ্যকে সহায়তা করবে। অপরদিকে UISEE-এর স্বয়ংক্রিয় মোবিলিটি সমাধান, লজিস্টিকস ডিজিটালাইজেশন ও স্মার্ট-সিটি উন্নয়নের প্রচেষ্টার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এছাড়া এনার্জি স্টোরেজ প্রযুক্তির প্রতি মনোযোগ সৌদি আরবের বৃহত্তর নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তরের প্রতিফলন। দেশটি ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুতের ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যে এগোচ্ছে, যা বৃহৎ আকারের জ্বালানি সঞ্চয়ের চাহিদা সৃষ্টি করেছে।
চীনে সৌদি মন্ত্রী আল খুরাইফের সঙ্গে সফরে ছিলেন জাতীয় শিল্প উন্নয়ন কেন্দ্রের সিইও সালেহ আল সুলামি, NIDLP-এর ভারপ্রাপ্ত সিইও জামিল আল ঘামেদি, এবং সৌদি শিল্প ও খনন খাতের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
জাপান সফর
জাপানে পৃথক সফরের নেতৃত্বে রয়েছেন সৌদি বিনিয়োগমন্ত্রী খালিদ আল-ফালিহ। তিনি জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী ইওজি মুটো এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসায়ুকি ফুজির সঙ্গে যৌথভাবে অষ্টম সৌদি–জাপান ভিশন ২০৩০ কমিটির বৈঠক পরিচালনা করেন। বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক অগ্রগতি পর্যালোচনা হয় এবং ভিশন ২০৩০ এর অধীনে অঙ্গীকার পুনর্নিশ্চিত করতে সরকারি কার্যবিবরণীতে স্বাক্ষর করা হয়। এই উচ্চপর্যায়ের সফর সৌদি–জাপান সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে এই দেশ দুটির মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিলো ১৩৮.২ বিলিয়ন ডলারে। জাপান সৌদি আরবের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার।
এই সময় (২০২৪ অর্থবছর) সৌদি আরবে জাপানের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২৩.১ বিলিয়ন ডলার, যা মূলত জ্বালানি, পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবহন, লজিস্টিকস এবং উৎপাদন খাতে কেন্দ্রীভূত।
সরকারি এক্স একাউন্টে এক বিবৃতিতে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিনিয়োগমন্ত্রী খালিদ আল ফালিহ সৌদি–জাপান ফিনান্সিয়াল রাউন্ড টেবিল বৈঠকে শীর্ষ অর্থায়নকারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এতে খাতভিত্তিক সুযোগ, আর্থিক সম্পূরকতা ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা হয়। দুই দেশের সমকক্ষদের মধ্যে সহযোগিতা উন্নীত করার পদক্ষেপও নেওয়া হয়।
এতে আরও বলা হয় যে, সৌদি–জাপান ভিশন ২০৩০ কাঠামোর আওতায় অনুষ্ঠিত এই গোল টেবিল বৈঠকে জাপানের প্রধান শিল্প প্রতিষ্ঠানের ৪০ জন ঊর্ধ্বতন নেতা অংশ নিয়েছেন। মানসম্মত বিনিয়োগ ও বেসরকারি খাতের উদ্যোগ বাড়াতে জাপানের বিনিয়োগ মন্ত্রণালয় কর্তৃক কেইদানরেন স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যাটফর্মও চালু করা হয়।
এ আলোচনায় সৌদি ইস্পোর্টস ফেডারেশনের চেয়ারম্যান প্রিন্স ফয়সাল বিন বান্দার বিন সুলতান এবং কেইদানরেন এর ভাইস চেয়ারম্যান মাসায়ুকি হিয়োদোও অংশ নেন।