শুক্রবার, মে ৩০, ২০২৫

আজ ইস্তাম্বুল বিজয়ের ৫৭২তম বর্ষপূর্তি

spot_imgspot_img

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয়ই কনস্টান্টিনোপল বিজিত হবে। সে বাহিনীর আমীর কতই না উত্তম আমীর, সে বাহিনী কতই না উৎকৃষ্ট বাহিনী।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণীকে বাস্তবায়ন এবং গৌরবময় বিজয় ও সুসংবাদপ্রাপ্ত উৎকৃষ্টতম দলের সৌভাগ্যবান আমীর ও সদস্যদের একজন হওয়ার আশায় ইসলামের শুরু লগ্ন থেকেই মুসলিম বীর মুজাহিদগণ কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

হযরত উসমান রাযিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর শাসনামলে হযরত মুয়াবিয়া রাযিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর নেতৃত্বে নৌবহর গঠিত হলে গ্রিকদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। তখন থেকেই বাইজেন্টাইনদের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পরিকল্পনা শুরু হয়।

মুসলমানরা কনস্টান্টিনোপলে প্রথম অভিযান পরিচালনা করেন উমাইয়া খলিফা হযরত মুয়াবিয়া রাযিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর শাসনামলে, ৬৭৪ সালে।

সেই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন বয়সে বৃদ্ধ সাহাবী হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রাযিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু। যুদ্ধ চলাকালীন তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে ইন্তিকাল করেন। তাঁকে সেখানেই দাফন করা হয়।

দ্বিতীয়বার ৭১৬-১৭ খ্রিষ্টাব্দে সপ্তম উমাইয়া খলিফা সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিকের শাসনামলে কনস্টান্টিনোপলের অভিমুখে অভিযান পরিচালনা করা হয়।

আব্বাসীয় তৃতীয় খলিফা আল মাহদির সময়ে খলিফা হারুনুর রশীদের নেতৃত্বে কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করা হয়। ৭৮২ সালের এই অভিযানে আব্বাসীয়রা সাফল্য অর্জন করেন। এতে বাইজেন্টাইনরা কর দিতে সম্মত হয়।

খলিফা হারুনের শাসনামলে তৎকালীন সম্রাট নাইসিফোরাস কর দিতে অস্বীকৃতি জানালে খলিফা অভিযান চালিয়ে হিরাক্লিয়া দখল করেন। তবে কনস্টান্টিনোপল তখনও অজেয় থেকে যায়।

পরবর্তীতে আব্বাসীয় খেলাফতে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে মুসলমানদের কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের স্বপ্ন অক্ষুণ্ণই থেকে যায়। এছাড়াও সেলজুকরা কনস্টান্টিনোপলের অভিমুখে কিছু অভিযান চালিয়েছিল, তবে তা তেমন ফলপ্রসূ হয়নি।

উসমানীয় প্রস্তুতি ও রাজনৈতিক প্রতিকূলতা

১৩৯৬ সালে নিকোপলিসের যুদ্ধের পর উসমানী সুলতান প্রথম বায়জিদ কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের সংকল্প করেন। কিন্তু বাইজেন্টাইনদের প্ররোচনায় তৈমুর লং উসমানী সাম্রাজ্য ধ্বংসের লক্ষ্যে আঙ্কারার দিকে অগ্রসর হন। ১৪০২ সালে বায়জিদ ও তৈমুরের দুটি মুসলিম বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি হন। এ যাত্রায় কনস্টান্টিনোপল উসমানীদের হাত থেকে রক্ষা পায়।

১৪২১ সালে সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ উসমানী সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। দ্বিতীয় মুরাদের সিংহাসনে আরোহনের পর বাইজেন্টাইনদের ষড়যন্ত্রে উসমানী সাম্রাজ্যে একের পর এক বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়। সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ ক্ষুব্ধ হয়ে বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে কনস্টান্টিনোপল আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।

১৪২১ সালে তিনি কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করেন এবং বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সুলতান মুরাদ যখন কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই বাইজেন্টাইনদের প্ররোচনায় এশিয়া মাইনরে ভয়াবহ বিদ্রোহ সৃষ্টি করেন মুরাদের ভাই মোস্তফা। ফিরে এসে শক্ত হাতে বিদ্রোহ দমন করেন মুরাদ এবং মোস্তফাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। ফলে আবারও রক্ষা পায় কনস্টান্টিনোপল।

সুলতান মুহাম্মাদ ১৪৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মার্চ তৎকালীন উসমানী রাজধানী আন্দ্রিয়ানোপলে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই শাহজাদা মুহাম্মাদের জন্য কিছু দ্বীনি শিক্ষক নিযুক্ত করেন সুলতান মুরাদ। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে আক শামসুদ্দিন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনিই ছোটবেলা থেকেই সুলতান মুহাম্মাদকে কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের জন্য অনুপ্রাণিত করতেন।

১১ বছর বয়সেই সুলতান মুহাম্মাদ এমাসিয়া অঞ্চল শাসনের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৪৪৪ সালের ১২ জুলাই সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ ও ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের মাঝে ১০ বছরের শান্তিচুক্তি হলে, নিজ সন্তান ১২ বছর বয়সী সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদকে ক্ষমতায় বসিয়ে অবসরে চলে যান দ্বিতীয় মুরাদ।

১২ বছর বয়সী মুহাম্মাদকে ক্ষমতায় দেখে দুই মাসের মধ্যেই শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করে খ্রিষ্টানরা উসমানী সাম্রাজ্যে আক্রমণ চালায়। এ সময় সুলতান মুহাম্মাদ তাঁর পিতাকে পুনরায় ক্ষমতায় বসার অনুরোধ করলে সুলতান মুরাদ অস্বীকৃতি জানান। তখন সুলতান মুহাম্মাদ ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন,
“যদি আপনি সুলতান হন, তাহলে এগিয়ে এসে আপনার সৈন্যদের নেতৃত্ব দিন। আর যদি আমি সুলতান হয়ে থাকি, তাহলে আমি নির্দেশ দিচ্ছি—আপনি আমার সৈন্যদের নেতৃত্ব দিন।”

১৪৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ নভেম্বর সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ পুনরায় ক্ষমতায় আসেন এবং ভারনার যুদ্ধে পোল্যান্ডের সম্রাট ভ্লেডিস্লাও ও সেনাপতি জন হানিয়াডির নেতৃত্বাধীন হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড ও ভালাকিয়ার যৌথ খ্রিষ্টান বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন।

১৪৫১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ ইন্তিকাল করলে দ্বিতীয়বারের মতো সিংহাসনে আরোহন করেন সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ। বাইজেন্টাইনরা আবারও ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা সুলতানকে পূর্বের ন্যায় দুর্বল ভেবে তাঁদের হাতে বন্দী থাকা সুলতানের ভাইকে মুক্ত করে বিদ্রোহ বাঁধানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সুলতান তাঁদের সকল ষড়যন্ত্র বানচাল করে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে কনস্টান্টিনোপল অবরোধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।

কনস্টান্টিনোপলের দুর্গ ও যুদ্ধের প্রস্তুতি

কনস্টান্টিনোপল ছিল প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩ শতক থেকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ শহর। এর তিন দিকে জল ও এক দিকে স্থল। পূর্বে বসফরাস প্রণালি, উত্তরে গোল্ডেন হর্ন ও দক্ষিণে মারমারা উপসাগর। এটি ছিল ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগরের সংযোগস্থল এবং বসফরাস প্রণালির তীরে অবস্থিত। এমন গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এটি ছিল তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য নগরী।

সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের জন্য তৎকালীন বিশ্বের সর্বোচ্চ যুদ্ধপ্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তিনি হাঙ্গেরিয়ান কামান প্রস্তুতকারী ‘আরবান’-এর মাধ্যমে সবচেয়ে দূরপাল্লার কামান তৈরি করেন, যা ‘শাহী কামান’ নামে পরিচিত। যথাযথ প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে তিনি ১৪৫৩ সালের ৬ এপ্রিল কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করেন।

কনস্টান্টিনোপলের তিন দিকে জলসীমা থাকায় স্থলভাগেই আক্রমণ শুরু করে উসমানীয় বাহিনী। গোল্ডেন হর্ন গুরুত্বপূর্ণ একটি সমুদ্রবন্দর। এদিক থেকে আক্রমণের আশঙ্কায় গোল্ডেন হর্নের মুখে শিকল দিয়ে আটকে দেয় বাইজেন্টাইন বাহিনী। ফলে উসমানীয় নৌবাহিনী বসফরাস প্রণালি দিয়ে গোল্ডেন হর্নে ঢুকতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়।

গোল্ডেন হর্নে শিকল দিয়ে সুরক্ষা নিশ্চিত করার পর স্থলভাগে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে উসমানীয়দের প্রতিহত করতে থাকে বাইজেন্টাইন বাহিনী। এতে করে কনস্টান্টিনোপলের দুর্ভেদ্য প্রাচীর কোনোভাবেই অতিক্রম করতে পারছিলেন না উসমানীয়রা। সুলতান মুহাম্মাদের একের পর এক রণকৌশল খুব সফলভাবেই ভেস্তে দিচ্ছিল বাইজেন্টাইন বাহিনী।

লাগাতার অবরোধে কনস্টান্টিনোপল দখল করতে না পেরে একরকম হতাশ হয়ে পড়েন সুলতান মুহাম্মাদ। সেনাদের ক্লান্তি ও লাশের সারি ক্রমাগত দীর্ঘ হয়ে যাওয়ায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন তিনি। তখন কিছুদিন তিনি আধ্যাত্মিক ধ্যানে মশগুল থেকে আল্লাহর কাছে কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের জন্য দোয়া করতে থাকেন।

এর মধ্যে তিনি স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় সাহাবী হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রাযিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে দেখতে পান। তিনি সুলতান মুহাম্মাদকে কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের অনুপ্রেরণা দেন এবং কনস্টান্টিনোপলের অদূরে নিজের কবরের সন্ধান দেন। পরবর্তীতে স্বপ্নে নির্দেশিত স্থানে মাটি খুঁড়ে আবু আইয়ুব আনসারী রাযিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর কবরের বিষয়টি নিশ্চিত হয়।

গোল্ডেন হর্নের মুখে শিকল দিয়ে বাধা দেওয়ার কারণে শুধু স্থলভাগেই আক্রমণ সীমাবদ্ধ রাখতে হয় উসমানীয়দের। গোল্ডেন হর্নের দিক থেকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে সুলতান মুহাম্মাদ এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি স্থলপথে জাহাজ চালিয়ে বিশ্ববাসীকে চমকে দেন।

তিনি রাতের আধারে গাছের টুকরোয় চর্বি দিয়ে পিচ্ছিল করে তাতে ৮০টি রণতরী বসফরাস থেকে প্রায় ১০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে গোল্ডেন হর্ন সমুদ্র বন্দরে নিয়ে আসেন।

অবশেষে গোল্ডেন হর্ন ও স্থলভাগ—উভয় দিক থেকেই আক্রমণের সুযোগ তৈরি করে উসমানীয়রা। বাইজেন্টাইনরা টের পেয়ে গোল্ডেন হর্নে সেনা মোতায়েন করলে, অন্যদিকে প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।

চূড়ান্ত আক্রমণ, বিজয় ও নতুন ইতিহাসের সূচনা

২৮ মে ১৪৫৩ ঈসাব্দের রাতে সুলতান মুহাম্মাদ কনস্টান্টিনোপলে চূড়ান্ত হামলার ঘোষণা দেন। ২৯ মে সকালে উসমানীয়দের একের পর এক হামলায় পর্যুদস্ত হয় বাইজেন্টাইন বাহিনী। সে সময় সাধারণ মানুষ, এমনকি নারীরাও উসমানীয়দের প্রতিহত করতে রণক্ষেত্রে নেমে আসে।

দুর্গের প্রাচীর ভেদ করার পর সুলতান মুহাম্মাদ তাঁর বিশেষ জেনিসারি বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসেন। তাঁদের অন্যতম বীর সেনা হাসান আগা বীরত্বের সঙ্গে বাইজেন্টাইন সেনাদের প্রতিহত করে দুর্গে উসমানীয়দের চাঁদখচিত পতাকা উড্ডীন করতে সক্ষম হন। কথিত আছে, সেন্ট রোমান্স-এর উপর সর্বপ্রথম উসমানীয় পতাকা উড্ডীন হয়। দুর্গে পতাকা দেখে উসমানীয়দের স্পৃহা বেড়ে যায় এবং তারা অগ্রসর হলে যুদ্ধের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হয়ে যায়।

রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইন আসন্ন পরাজয় দেখতে পেয়ে নিজের রাজকীয় পোশাক খুলে যুদ্ধে আবর্তিত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে ১,১০০ বছরের বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘটে এবং মুসলমানদের জন্য এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়।

২৯ মে সুলতান মুহাম্মাদ বিজয়ীর বেশে কনস্টান্টিনোপলে প্রবেশ করেন। তিনি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। তিনি নারী-শিশুদের প্রতি যে দয়া দেখিয়েছেন, তা খ্রিষ্টান ইতিহাসবিদরাও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।

সুলতান মুহাম্মাদ শহরের নাম পরিবর্তন করে “ইসলাম বুল” তথা “ইসলামের শহর” রাখেন। পরবর্তীতে তা পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানের ইস্তাম্বুল নামে পরিচিত হয়। তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের রাজধানী আন্দ্রিয়ানোপল থেকে ইস্তাম্বুলে স্থানান্তর করেন। তখন থেকে তিনি মুহাম্মাদ আল ফাতিহ, অর্থাৎ বিজেতা মুহাম্মাদ নামে পরিচিত হন।

সর্বশেষ

spot_img
spot_img
spot_img