বৃহস্পতিবার | ২৬ জুন | ২০২৫

আজ শহীদ জিয়ার ৪৪তম শাহাদাতবার্ষিকী

spot_imgspot_img

আজ ৩০ মে। বাংলাদেশের ইতিহাসে গভীর শোক ও শ্রদ্ধার দিন। এই দিনে, ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে শাহাদাতবরণ করেন স্বাধীনতার ঘোষক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। মাত্র ৪৫ বছর বয়সে এই দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়কের জীবনাবসান ঘটে। তার শাহাদাতবার্ষিকীতে জাতি আজ স্মরণ করছে এক দুরদর্শী, দৃঢ়চেতা এবং অমিত সাহসী নেতাকে, যিনি শুধু একটানা ৬ বছর রাষ্ট্র চালিয়েই নয়, স্বাধীনতার পথ তৈরি করে দিয়েছেন জাতিকে।

জিয়াউর রহমানের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি, বগুড়ার গাবতলী উপজেলার বাগবাড়ি গ্রামে মাতুলালয়ে। তার বাবা মনসুর রহমান ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী ও একজন কেমিস্ট। শৈশব থেকেই জিয়া ছিলেন আত্মনির্ভরশীল, মিতভাষী ও শৃঙ্খলাপ্রিয়। দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে করাচিতে যান এবং সেখানেই শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে ভর্তি হন।

১৯৫৫ সালে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে সেনাসেবায় যোগ দেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে তার সাহসিকতা ও নেতৃত্ব প্রশংসিত হয়। তার কোম্পানি ছিল সর্বাধিক খেতাবপ্রাপ্ত ইউনিট। সৈনিক জীবনে তিনি যেমন চরম পেশাদারিত্ব দেখিয়েছেন, তেমনি জাতীয় সংকটের সময়ও নির্ভীকভাবে রাষ্ট্রের হাল ধরেছেন।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর হামলার সময় চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা’ করেন মেজর জিয়াউর রহমান। দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক এবং পরবর্তীতে গঠিত জেড ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তার বীরত্ব ও অবদানের জন্য সরকার তাকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে।

১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে তিনি বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই মুহূর্ত থেকেই তিনি জাতির সংকটময় সময়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন শুরু করেন। এই নেতৃত্ব ছিল অনিশ্চয়তার মধ্যকার এক সাহসী পদক্ষেপ।

জিয়াউর রহমানের অন্যতম কৃতিত্ব ছিল দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন, রাজনৈতিক বৈচিত্র্য ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টি করেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার অনুমতি দিয়ে তিনি একটি রাজনৈতিক সৌজন্য এবং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ভারসাম্যের ভিত্তি স্থাপন করেন।

তিনি “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” নামে একটি নতুন রাষ্ট্রদর্শন উপস্থাপন করেন—যার মূল ভিত্তি ছিল ইসলামী মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এবং জাতীয় স্বার্থ। এই দর্শনের ভিত্তিতে গড়ে তোলেন একটি উদার ও বহুমাত্রিক রাজনৈতিক দল বিএনপি, যেখানে চরম বাম ও চরম ডান উভয়েরই স্থান ছিল।

মাত্র ছয় বছরের শাসনামলে তিনি দেশকে আত্মনির্ভরতার পথে এগিয়ে নেন। চালু করেন “নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে” দর্শন। কৃষি বিপ্লব, গ্রামোন্নয়ন বোর্ড, ক্ষুদ্রশিল্প ও কুটিরশিল্প, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্স প্রবাহ, নবযুবকদের প্রশিক্ষণসহ বহু উদ্যোগ ছিল তার শাসনকালের অবদান। তার সময়েই বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে এগোয়। প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন, আমলাতন্ত্রে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি চালু করেন।

শহীদ জিয়া ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী এক নেতা—যিনি জীবনযাপনে ছিলেন সাদামাটা, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় ছিলেন দূরদর্শী। তিনি রাজনীতিকে জনসম্পৃক্ত করেছেন। তার ব্যতিক্রমী সততা এতটাই সুপরিচিত ছিল যে, রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি পরিবারের জন্য আলাদা সুবিধা নেননি। নিজ সন্তানদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বিরত রেখেছেন। জাতির প্রত্যাশা পূরণে তার নির্লোভ ও নির্মোহ মনোভাব আজও স্মরণীয়।

১৯৮১ সালের ৩০ মে গভীর রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে কতিপয় সেনা সদস্যের হাতে শহীদ হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। সেই সময় তার বয়স ছিল ৪৫ বছর ৪ মাস ১১ দিন। তার শাহাদাত জাতিকে স্তব্ধ করে দেয়। এক সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রনায়কের অকালপ্রয়াণে দেশবাসী হারায় ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শককে।

তার জানাজার দিন ঢাকায় লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নামে। জনস্রোতের কারণে কফিন দেখতে না পারলেও মানুষ হৃদয়ে ধারণ করেছে তার স্মৃতি। জাতীয় সংসদের সামনে জানাজা শেষে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়। আকাশ-বাতাস ভারী করে কান্না ছড়িয়ে পড়ে। কবি আল মাহমুদের ভাষায়—“একটি কফিনের পাশে বাংলাদেশ।”

সর্বশেষ

spot_img
spot_img
spot_img