সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ সুইদায় সম্প্রতি সংঘটিত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ দেশটির অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকে গভীর সংকটে ফেলেছিল। একদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা, অন্যদিকে ইসরাইলি আগ্রাসন, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল চরম মাত্রায়। এই ভয়াবহ প্রেক্ষাপটে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমাদ আল-শারাআ আল-জুলানী সরাসরি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। শান্তি, ঐক্য ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার বার্তা দেন তিনি।
শনিবার দেওয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট জুলানী সুইদা প্রদেশে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানান। ইসরাইলি হস্তক্ষেপ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট জুলানী বলেন, “আমি আরব গোত্রগুলোকে আহ্বান জানাচ্ছি যেন তারা সুইদায় পূর্ণ ও তাৎক্ষণিক অস্ত্রবিরতি বজায় রাখে। সিরিয়া কোনো সাম্প্রদায়িক উসকানি বা বিভাজনের প্রকল্প বাস্তবায়নের ময়দান নয়। রাষ্ট্রের শক্তি আসে জনগণের পারস্পরিক বন্ধন ও ঐক্য থেকে।”
তিনি বলেন, “আরব গোত্রগুলো যুগে যুগে সিরিয়ার নৈতিকতা ও মহৎ মূল্যবোধের প্রতীক ছিল। তাদের ওপর আমাদের আস্থা রয়েছে।”
“বুদ্ধিমত্তা ও সংযমের কণ্ঠস্বরকে প্রাধান্য দিতে হবে, এবং প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার ভাষা যারা ছড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। ইতোমধ্যে মার্কিন ও আরব দেশগুলোর পক্ষ থেকে উত্তেজনা কমাতে মধ্যস্থতা হয়েছে।”
প্রেসিডেন্ট জুলানী জানান, “আমরা বহু আন্তর্জাতিক পক্ষ থেকে আহ্বান পেয়েছি যাতে সুইদায় পুনরায় হস্তক্ষেপ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, কিছু ব্যক্তি বাইরে থেকে শক্তি আহরণ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সামনে আসছে। ইসরাইলি আগ্রাসনের ফলে দক্ষিণাঞ্চলে এবং রাজধানী দামেস্কে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, যা দেশের স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ঝুঁকিতে ফেলেছে।”
তিনি বলেন, “সুইদার সাম্প্রতিক সংঘর্ষ একটি বিপজ্জনক মোড় নিয়েছিল এবং সহিংসতা প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল, যদি না রাষ্ট্র সময়মতো হস্তক্ষেপ করতো। আমাদের স্পষ্ট বার্তা, সুইদা এখনো সিরিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং দ্রুজ সম্প্রদায় আমাদের জাতীয় ঐক্যের একটি মূল স্তম্ভ।”
প্রেসিডেন্ট জুলানী আরও বলেন, “আমরা দৃঢ়ভাবে বলছি, দ্রুজ সম্প্রদায়ের একটি ক্ষুদ্র অংশের অবস্থান দিয়ে পুরো সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না। তাদের একটি গৌরবময় ইতিহাস আছে এবং তাদের অবস্থান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে।”
তিনি বলেন, “রাষ্ট্র সবসময় সুইদার পাশে থেকেছে, বিশেষত সিরিয়ার স্বাধীনতার পর। তবে কিছু পক্ষ শহরের ভূমিকা ও সম্মানকে ক্ষুণ্ণ করেছে।”
“রাষ্ট্র থেকে অনুপস্থিতির সুযোগে সুইদা থেকে কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী বেদুইন জনগণের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা চালিয়েছে, যার সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটেছে। এসব হামলা অন্য গোত্রগুলোকে বাধ্য করেছে বেদুইনদের অবরোধমুক্ত করতে। আমরা স্পষ্ট করে বলছি, এসব অপরাধের সঙ্গে রাষ্ট্র জড়িত নয়।”
তিনি বলেন, “রাষ্ট্রীয় অবস্থান পরিষ্কার, যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হোক না কেন, তা হোক সুইদায় বা বাইরে, আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি এবং সবার জন্য বিচার নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
প্রেসিডেন্ট জুলানী জোর দিয়ে বলেন, “এই সময়টা এমন এক মুহূর্ত যা আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য করে। আমাদের দেশ, আমাদের ভূমি, এই দুইয়ের সুরক্ষা সবার আগে। আর এ জন্য পুরো জাতির সম্পূর্ণ ঐক্য দরকার।”
তিনি বলেন, “সিরিয়া একমাত্র রাষ্ট্রীয় কাঠামো যার পক্ষে দেশের প্রতিটি অংশে সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদা বজায় রাখা সম্ভব।”
তিনি বলেন, “সিরিয়ার ঐক্য ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে ব্যাপক ঐকমত্য গড়ে উঠেছে, তা দেশটির প্রতি বিশ্বজনতার আন্তরিকতার পরিচায়ক।”
আন্তর্জাতিক ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানাই, যারা এই কঠিন পরিস্থিতিতে সিরিয়ার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। একইসঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও চীন বারবার ইসরাইলি হামলার বিরোধিতা করেছে এবং সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের প্রতি সমর্থন জানিয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।”
তিনি বলেন, “গত কয়েক মাসের ঘটনাগুলো প্রমাণ করে দিয়েছে, সুইদার সব সম্প্রদায়ের মানুষ রাষ্ট্রের পাশে আছে এবং বিভাজনের যেকোনো প্রকল্প প্রত্যাখ্যান করেছে।”
প্রেসিডেন্ট জুলানী বলেন, “সিরিয়া প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, দেশের সব সংখ্যালঘু ও সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে এবং যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে।”
তিনি বলেন, “আমরা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছি, সুইদা থেকে হোক বা দেশের অন্য কোনো প্রান্ত থেকে—সব ধরনের অপরাধ ও অনিয়মের দায় আমরা অস্বীকার করছি। আমরা চাই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হোক এবং আইন প্রয়োগ হোক সমভাবে।”
“এই স্পর্শকাতর মুহূর্তে শান্তির কণ্ঠকে সামনে আনতে হবে। বিবেকবান ও প্রজ্ঞাবানদের জন্য জায়গা খুলে দিতে হবে, যাতে তারা জাতিকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে পারে।”
প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের ঘোষণা
শনিবার সকালে সিরীয় প্রেসিডেন্টের কার্যালয় জানায়, “সুইদায় অবিলম্বে ও সর্বাত্মক অস্ত্রবিরতি কার্যকর হয়েছে। সব পক্ষকে সহিংসতা ও সংঘর্ষ থেকে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে এবং নাগরিকদের সুরক্ষায় নিরাপত্তা বাহিনী বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে।”
মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর ভূমিকা
যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়া বিষয়ক বিশেষ দূত টম বারাক জানিয়েছেন, “ওয়াশিংটনের সহায়তায় ইসরাইল ও সিরিয়ার মধ্যে অস্ত্রবিরতির চুক্তি হয়েছে, এতে তুরস্ক, জর্ডান এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশও সমর্থন জানিয়েছে।”
ইসরাইলি সম্প্রচার সংস্থা জানায়, “যেসব ইসরায়েলি দ্রুজ সদস্য সীমান্ত অতিক্রম করে সিরিয়ায় প্রবেশ করেছিল, তাদের সবাইকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।”
সূত্র: আলজাজিরা