বৃহস্পতিবার | ৪ ডিসেম্বর | ২০২৫

ভারতের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক চুক্তি অনুমোদন রাশিয়ার

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দু’দিনের সফরে ভারতে আসছেন। তার আগেই রাশিয়ার পার্লামেন্ট ভারতের সাথে গুরুত্বপূর্ণ এক সামরিক চুক্তির অনুমোদন দিয়েছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আহ্বানে ২৩তম ভারত-রাশিয়া বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) দিল্লি আসছেন পুতিন। এই সফরে সামরিক, বাণিজ্য ও খনিজ তেলের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এছাড়াও পুতিনের সফর শুরুর ঠিক আগেই তার মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ক্ষেত্রে রাশিয়া কতটা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে, তা নির্ভর করছে ভারত কতটা এগিয়ে আসতে চায় তার ওপর।

কী আছে ‘রেলোস’ চুক্তিতে?

দুই দেশের মধ্যে এই ‘রেসিপ্রোকাল এক্সচেঞ্জ অফ লজিস্টিক সাপোর্ট’ বা ‘রেলোস’ চুক্তি অবশ্য সই হয়ে গিয়েছিল গত ১৮ ফেব্রুয়ারি। তবে সেটি মঙ্গলবার রাশিয়ার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ‘স্টেট ড্যুমা’র অনুমোদন পেয়েছে।

বার্তাসংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, গত সপ্তাহে চুক্তিটি ড্যুমার কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্তিন। স্টেট ড্যুমার স্পিকার ভ্যাচেস্লাভ ভোলোদিন সভার শুরুতে তার ভাষণে ভারতের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ককে ‘সার্বিক ও কৌশলগত’ বলে বর্ণনা করেন। এই সম্পর্ককে যে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় তার দেশ, সেটাও উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যে চুক্তির অনুমোদন দেয়া হচ্ছে, তা পারস্পরিক বোঝাপড়া আরো বাড়াবে এবং নিঃসন্দেহে আমাদের সম্পর্ক আরো উন্নত করবে।’

ভারত আর রাশিয়ার মধ্যে যে রেলোস চুক্তি হয়েছে, তা মূলত এক দেশ অপর দেশটিতে সামরিক বাহিনীর সদস্য, সরঞ্জাম, যুদ্ধ জাহাজ, সামরিক বিমান পাঠানোর কার্যপদ্ধতি। চুক্তি অনুযায়ী, শুধু যে বাহিনীর সদস্যদের অথবা সরঞ্জাম একটি দেশ অপর দেশে পাঠাতে পারবে, তা নয়। অপর দেশটিতে গিয়ে সেখানকার সামরিক পরিকাঠামোও ব্যবহার করা যাবে। যৌথ মহড়া, প্রশিক্ষণ, মানবিক সহায়তা এবং ত্রাণ ও উদ্ধার কাজের ক্ষেত্রে এই চুক্তি অনুযায়ী সামরিক সহায়তা করবে একে অপরকে।

স্টেট ড্যুমার ওয়েবসাইটে রাশিয়ার মন্ত্রিসভাকে উদ্ধৃত করে লেখা হয়েছে যে একটি দেশ অপর দেশের আকাশসীমা ও বন্দর সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে।

হতে পারে আরো সামরিক চুক্তি?

রাশিয়ার ফার্স্ট ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার ডেনিস মান্তুরোভ বার্তাসংস্থা এএনআইকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারতের সাথে তার দেশের সামরিক সহযোগিতা একটি কৌশল। এর পরের ধাপে কারিগরি ও শিল্পোদ্যোগ পর্যায়ে গভীর সহযোগিতার দিকে এগোবে দুটি দেশ।

ওই সাক্ষাৎকারে মন্তুরোভ বলেন, দুটি দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল স্তম্ভগুলো হলো যৌথভাবে উদ্ভাবন ও উৎপাদন এবং স্থানীয় পরিবেশের সাথে সরঞ্জামগুলোকে খাপ খাইয়ে নেয়ার পদ্ধতি।

তিনি এ-ও বলেন, ভারতের মোট সামরিক সরঞ্জামের মধ্যে ৩০ শতাংশেরও বেশি মস্কো দিয়ে থাকে এবং গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এটাই চলে আসছে।

মন্তুরোভ আরো বলেন, ‘আমাদের দু’টি দেশের মধ্যে সামরিক-কারিগরি সহযোগিতার কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এই সহযোগিতা প্রতিবছরই আরো উন্নত ও শক্তিশালী হচ্ছে।’

বার্তাসংস্থা রয়টার্স বলছে, দিল্লি সফরকালে পুতিনের সাথে আলোচনায় সুখোই-ফিফটি সেভেন যুদ্ধবিমান ভারতকে দেয়া নিয়েও আলোচনা হতে পারে। এগুলো সব থেকে আধুনিক যুদ্ধবিমান। ভারতের যে ২৯টি যুদ্ধবিমানের স্কোয়াড্রন আছে, তার বেশিভাগই রাশিয়ার তৈরি সুখোই-থার্টি।

বার্তাসংস্থাটি আরো জানিয়েছে, রাশিয়ার সাথে এই সপ্তাহের আলোচনায় উঠে আসতে আরো কয়েকটি এস-ফোর হান্ড্রেড আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার কথাও। গত সপ্তাহে ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব রাজেশ কুমার সিং এই ইঙ্গিত দিয়েছেন। রাশিয়ার সাথে ২০১৮ সালের এক চুক্তি অনুযায়ী ভারত ইতোমধ্যেই তিনটি এস-ফোর হান্ড্রেড পেয়ে গেছে, আরো দুটি পাওনা আছে তাদের।

সংবাদ সংস্থা এএনআইকে মন্তুরোভ জানিয়েছেন, এস-ফোর হান্ড্রেড আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সময়মতোই সরবরাহ করা হবে। এই এস-ফোর হান্ড্রেড ‘ট্রায়াম্ফ’ লম্বা রেঞ্জের বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। এছাড়াও শব্দের চেয়েও দ্রুতগতির ‘ব্রাহ্মোস’ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নততর ভ্যারিয়্যান্ট কেনা নিয়েও আলোচনা হতে পারে।

‘বল এখন ভারতের কোর্টে’

রাশিয়ার সাথে ভারত তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কতটা নিবিড় করতে চায়, সেটা দিল্লির হাতেই ছেড়ে দিয়েছে মস্কো, এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ‘বল এখন ভারতের কোর্টে।’

পুতিনের সফরের ঠিক আগে, মঙ্গলবার তার মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ যোগ দিয়েছিলেন এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে। তিনি বলেন, চীনের সাথে রাশিয়ার সম্পর্কের দিগন্ত যেমন বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, ভারতের ক্ষেত্রেও তাই। তবে ওই সম্পর্ক কতটা বিস্তৃত হবে, তা নির্ভর করছে ভারতের ওপরে।

তার কথায়, ‘চীন আমাদের বিশেষ কৌশলগত সহযোগী। চীনের সাথে উচ্চস্তরের সহযোগিতা রয়েছে, যেমনটা আছে ভারতের সাথেও। চীনের সাথে সম্পর্ক আরো বিস্তৃত করার চেষ্টা করছি।’

তিনি বলেন, ‘ভারতের প্রতিও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি একই। কিন্তু ভারত যতটা এগিয়ে আসবে, আমরাও ততদূর পর্যন্ত এগিয়ে যেতে প্রস্তুত। ভারত যতদূর পর্যন্ত সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে, আমরাও তার জন্য প্রস্তুত আছি।’

পেসকভ এ-ও বলেন, রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক নিয়ে ভারতের ওপরে চাপ আছে। এই চাপের মধ্যেই দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সুরক্ষিত রাখার দরকার আছে।

ওই সংবাদ সম্মেলনে পেসকভ বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারি যে ভারতের ওপরে চাপ আছে। এজন্যই আমাদের সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে খুব সাবধান থাকতে হবে। আমাদের সম্পর্ক কোনো তৃতীয় দেশের প্রভাব-মুক্ত থাকা উচিত।’

পেসকভের সংবাদ সম্মেলনের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভেলিনা চাকারোভা এক বার্তায় বলেন, রাশিয়া ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ভারতের সাথে তাদের কৌশলগত সহযোগিতায় কোনো ‘সীমা থাকবে না’।

তিনি বলেন, ‘এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। চীনের ওপরে যাতে ভারতের নির্ভরতায় ভারসাম্য বজায় থাকে, তাই কৌশলগত দিক থেকে ভারতকেও একই পর্যায়ে রাখা হলো। যদি ভারত এই প্রস্তাব আংশিকভাবেও মেনে নয়, তাহলে এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণটাই বদলে যাবে। যার মধ্যে থাকবে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কূটনীতি, ব্রিকস প্লাস, জ্বালানি সরবরাহ এবং ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় ভারসাম্য। অনেক কিছুই আবারো বদলে যাবে।’

সূত্র : বিবিসি

spot_img

সর্বশেষ

spot_img

এই বিভাগের

spot_img