মঙ্গলবার | ২ ডিসেম্বর | ২০২৫

গাজ্জায় টার্গেট করে আল জাজিরার পাঁচ সাংবাদিককে হত্যা করলো ইসরাইল

গাজ্জায় দখলদার ইসরাইলের ভয়াবহ ও পরিকল্পিত হামলায় আল জাজিরার সাহসী সংবাদদাতা আনাস আল-শরীফসহ পাঁচ সাংবাদিক শাহাদাতবরণ করেছেন। সাংবাদিকদের ওপর এই বর্বর হামলা চালানো হয় গাজ্জা সিটির আল-শিফা হাসপাতালের প্রধান ফটকের বাইরে সাংবাদিকদের জন্য স্থাপিত একটি তাঁবুতে।

রবিবার রাতের শেষ দিকে চালানো এই সন্ত্রাসী হামলায় মোট সাতজন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন আল জাজিরার সংবাদদাতা মুহাম্মাদ কুরাইকা এবং ক্যামেরাপার্সন ইব্রাহিম জাহের, মুহাম্মাদ নুফাল ও মুয়ামেন আলিওয়া।

শাহাদাতের অল্প আগে ২৮ বছর বয়সী আনাস আল-শরীফ এক্সে পোস্ট করে জানান, গাজ্জা সিটির পূর্ব ও দক্ষিণ অংশে দখলদার বাহিনী ভয়াবহ ও ঘন বোমাবর্ষণ চালাচ্ছে, যা “ফায়ার বেল্ট” নামে পরিচিত। তার শেষ ভিডিওতে রাতের আকাশ কমলা রঙের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতে দেখা যায় এবং পেছনে শোনা যায় ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। তিনি লিখেছিলেন, “অবিরাম বোমাবর্ষণ… গত দুই ঘণ্টা ধরে গাজ্জা সিটিতে ইসরাইলি আগ্রাসন আরও তীব্র হয়েছে।”

৬ এপ্রিল মৃত্যুর আশঙ্কায় আগে থেকে লেখা এক বার্তায় আনাস আল-শরীফ বলেন, তিনি “সব বিবরণসহ যন্ত্রণার জীবন” কাটিয়েছেন এবং “বারবার দুঃখ ও ক্ষতির স্বাদ” নিয়েছেন। তবুও তিনি সত্য বিকৃত না করে তুলে ধরেছেন, যেন আল্লাহ সাক্ষী থাকেন তাদের ওপর, যারা নীরব থেকেছে, যারা হত্যাযজ্ঞ মেনে নিয়েছে এবং যারা তাদের নিঃশ্বাস রুদ্ধ করেছে। তিনি বলেন, “আমাদের শিশু ও নারীদের ছিন্নভিন্ন দেহও তাদের হৃদয় নরম করতে পারেনি বা দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে আমাদের জনগণের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞ থামাতে পারেনি।”

স্ত্রী বায়ানকে রেখে আসার কষ্ট এবং ছেলে সালাহ ও মেয়ে শামের বেড়ে ওঠা না দেখতে পাওয়ার বেদনা ব্যক্ত করেন তিনি।

আল জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক এক বিবৃতিতে এই হত্যাকাণ্ডকে “সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আরেকটি সুস্পষ্ট ও পরিকল্পিত হামলা” বলে নিন্দা জানিয়েছে। আল জাজিরা বলেছে, গাজ্জায় চলমান ইসরাইলি আগ্রাসনের ভয়াবহ পরিণতির মধ্যে এই হামলা চালানো হয়েছে, যেখানে অব্যাহতভাবে বেসামরিক মানুষ হত্যা, জোরপূর্বক অনাহার এবং সম্পূর্ণ সম্প্রদায় ধ্বংস করা হচ্ছে। আনাস আল-শরীফ ও সহকর্মীদের হত্যাকে গাজ্জা দখলের বাস্তবতা উন্মোচনকারী কণ্ঠস্বরগুলোকে নীরব করার মরিয়া প্রচেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করে নেটওয়ার্কটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে গণহত্যা বন্ধ ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানায়।

হামলার সময় ঘটনাস্থল থেকে এক ব্লক দূরে থাকা আল জাজিরার ইংরেজি বিভাগের সংবাদদাতা হানি মাহমুদ বলেন, আনাস আল-শরীফের শাহাদাতের খবর প্রচার করা তার গত ২২ মাসের যুদ্ধকালীন জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজ। তিনি বলেন, “সাংবাদিকরা নিহত হয়েছেন কারণ তারা গাজ্জায় ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অনাহার, দুর্ভিক্ষ ও অপুষ্টির বাস্তবতা অবিরাম তুলে ধরছিলেন এবং কারণ তারা এই অপরাধের সত্য সবার কাছে পৌঁছে দিচ্ছিলেন।”

দখলদার ইসরাইলি সেনারা স্বীকার করেছে যে তারা আনাস আল-শরীফকে লক্ষ্য করে হত্যা করেছে। তবে তারা দাবি করেছে, তিনি হামাসের একটি সেল পরিচালনা করছিলেন এবং ইসরাইলি বেসামরিক নাগরিক ও সেনাদের বিরুদ্ধে রকেট হামলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইসরাইলের এই অভিযোগ সম্পর্কে ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটর-এর বিশ্লেষক মুহাম্মাদ শেহাদা বলেছেন, “এর শূন্য প্রমাণ আছে। তার পুরো দিনের রুটিন ছিল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা।”

গত মাসে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আভিখাই আদরাঈ সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও প্রকাশ করে আনাস আল-শরীফকে হামাসের সামরিক শাখার সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত করলে জাতিসংঘের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আনাস আল-শরীফের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ যথার্থ, কারণ প্রমাণ বাড়ছে যে গাজ্জায় সাংবাদিকদের ইসরাইলি সেনারা অযাচিত অভিযোগের ভিত্তিতে লক্ষ্যবস্তু করছে এবং হত্যা করছে।

আল জাজিরা ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের সাংবাদিকদের হামাসের সঙ্গে যুক্ত দেখাতে ভুয়া প্রমাণ তৈরির অভিযোগ করেছে এবং গাজ্জায় তাদের সংবাদদাতাদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক প্রচারণার নিন্দা জানিয়েছে, যার শিকার ছিলেন আনাস আল-শরীফও। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসও গত মাসে সতর্ক করেছিল, তিনি ইসরাইলি সেনাদের কুৎসা-প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তু হচ্ছিলেন।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে দখলদার ইসরাইল গাজ্জায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ২০০-রও বেশি সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীকে হত্যা করেছে, যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আল জাজিরার সাংবাদিক ও তাদের স্বজনও আছেন।

সূত্র : আল জাজিরা

spot_img

সর্বশেষ

spot_img

এই বিভাগের

spot_img