আরিফ মুসতাহসান
মোল্লা আব্দুল গনী বেরাদার তালেবানের বর্তমান কূটনীতিক প্রধান। কাতারের দোহায় অবস্থিত তালেবানের কূটনীতিক অফিসে প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মুহাম্মাদ উমরের সহযোগী ছিলেন বেরাদার। তালেবানের কাবুল জয়ের মধ্য দিয়ে মার্কিন মদদপুষ্ট সাবেক আফগান সরকারের পতনের পর তিনি আফগানিস্তানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন বলে গুঞ্জন উঠেছে, তবে এখন পর্যন্ত তালেবানের পক্ষ থেকে এমন কিছুর ঘোষণা আসেনি।
মোল্লা আব্দুল গনী বেরাদার ১৯৬৮ সালে আফগানিস্তানের উরুজগন প্রদেশের ‘দেহ রাহউদ’ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পোপালজাই গোত্রের একজন দুররানি পশতুন। আধুনিক আফগানিস্তানের জনক আহমদ শাহ দুররানিও (যাকে আহদ শাহ আবদালীও বলা হয়) ছিলেন একই গোত্রের লোক।
বেরাদার ১৯৮০ সালে কান্দাহারে আফগানিস্তানের মুজাহিদীন বাহিনীর পক্ষে সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে লড়াই করেন। পরে তিনি মোল্লা উমরের সাথে কান্দাহারে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। পশ্চিমা মিডিয়ায় কথিত আছে, মোল্লা উমরের সাথে বেরাদারের আত্মীয়ের সম্পর্ক রয়েছে।
১৯৯৪ সালে মোল্লা উমর তরুণ আলেম ও মাদরাসার ছাত্রদের নিয়ে ইসলামি আন্দোলন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে তালেবান গঠন করেন। মোল্লা বেরাদার দক্ষিণ আফগানিস্তানে তালেবানকে প্রতিষ্ঠিত করতে মোল্লা উমরকে সহায়তা করেন৷ এবং মোল্লা উমরের সহযোগী হিসেবে কাজ করে যান।
১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানে অভাবনীয় সফলতা পায় তালেবান। বর্তমান সময়ে যেভাবে এক এক করে আফগানিস্তানের প্রদেশগুলো পুনরায় নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ঠিক তেমনিভাবে বিশ্বকে অবাক করে আফগানিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল মোল্লা উমরের তালেবান।
মোল্লা বেরাদার সেসময় কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। তাকে তালেবানের আফগান বিজয়ের অন্যতম কারিগর হিসেবে ধরা হয়।
১৯৯৬-২০০১ তালেবানের ৫ বছরের শাসনে মোল্লা বেরাদার নানান দায়িত্বে ভূমিকা পালন করেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি হেরাত এবং নিমরুজ প্রদেশের গভর্নর ছিলেন। এছাড়াও তিনি পশ্চিম আফগানিস্তানের সেনা কমান্ডারও ছিলেন। ইন্টারপোলের তথ্য মতে, আমেরিকা যখম তালেবান থেকে আফগানিস্তানের ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয় তখন তিনি সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন।
নাইন ইলেভেনের সময় ততকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ তথাকথিত ‘জঙ্গিবাদের’ দোহাই দিয়ে আফগানিস্তানে আক্রমণ করে। শুরুতে কঠোর মোকাবেলা করলেও আমেরিকা, ন্যাটো এবং আফগানী শত্রুদের বিরুদ্ধে টিকতে পারেনি তালেবানরা। আমেরিকা ও তাদের দোসররা হন্য হয়ে তালেবান নেতাদের খুজতে থাকে। তালেবান নেতারা কেউ নিজ দেশে কেউ কেউ পার্শ্ববর্তী দেশে আত্মগোপনে চলে যান।
২০০১ সালের নভেম্বরে তালেবানকে হটিয়ে হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে পুতুল সরকার গঠন করে আমেরিকা।
পরবর্তী সময়ে আমেরিকান বাহিনী ও তৎকালীন মার্কিন মদদপুষ্ট আফগান সরকারের বিরুদ্ধে শক্তি অর্জন করতে থাকেন বেরাদার। তিনি ‘কোয়েটা শূরা’র নেতৃত্ব দেন। এবং পাকিস্তান থেকে তালেবানের আন্দোলন পরিচালিত করেন। এর মধ্যে কয়েকবার শান্তি-আলোচনার চেষ্টা করেন বেরাদার। বিশেষ করে ২০০৪ এবং ২০০৯ সালে তিনি শান্তি-আলোচনার প্রস্তাব দেন।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সকালে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা (আইএসআই) এবং আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) এক যৌথ অভিযানে করাচি থেকে গ্রেফতার হন মোল্লা বেরাদার। তালেবানকে প্রতিহত করতে বেরাদারের গ্রেফতারকে অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট মনে করে আমেরিকা। পাকিস্তান গ্রেফতারের খবর কয়েক সপ্তাহ পর প্রকাশ করলেও এতে সংশ্লিষ্টতার কথা বরাবরই অস্বীকার করে। তৎকালীন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেহমান মালিক অস্বীকার করেন যে এতে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল। কারো ভাষ্যমতে তালেবান নেতাদের গ্রেফতার করে তৎকালীন সরকার নিজেদের অবস্থান উন্নত করতে চেয়েছিল। এছাড়াও আফগানিস্তানের কারজাই সরকারের সাথে সখ্যতা করাও অন্যতম কারণ হতে পারে।
অনেকের মতে পাকিস্তানি জেনারেল আশরাফ পারভেজ খায়ানী তালেবান নেতাদের সিরিজ গ্রেফতারকে নভেম্বরে নিজের অবসরকে বিলম্ব করতে ব্যবহার করেন। তিনি আমেরিকার কূটনীতিকদের সাথে সখ্যতা গড়েন, যেনো পাকিস্তান তাকে স্বপদে বহাল রাখে।
বেরাদারের গ্রেফতারের পর তালেবানের মিলিটারি কমান্ডার হন মোল্লা আব্দুল কাইয়ুম জাকির। ২০১২ সালে তালেবান নেতাদের মুক্তির চেষ্টা করা হয়। ২৩ নভেম্বর ২০১২ তালেবানের ৯ নেতাকে মুক্তি দিলেও বেরাদারকে ছাড়েনি পাকিস্তান।
২০১৫ সালে খবর প্রকাশিত হয় তালেবানের প্রধান মোল্লা মুহাম্মাদ উমর দুই বছর পূর্বে ২০১৩ সালে ইন্তেকাল করেন। তার ইন্তেকালের খবর ২বছর গোপন রাখে তালেবান। তার দাফন আফগানিস্তানের সীমান্ত অঞ্চল জাবুলে সম্পন্ন হয়। মোল্লা উমরের মৃত্যুর পর তালেবানে নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দেয়। ২০১৫ সালে আখতার মানসুর তালেবানের প্রধান হন। ২০১৬ সালে আমেরিকার এক ড্রোন হামলায় তিনি নিহত হলে শায়খুল হাদিস মাওলানা হিবাতুল্লাহ আখুন্দযাদা তালেবানের নেতৃত্বে আসেন। তিনি এখনো তালেবানের প্রধান হিসেবে রয়েছেন।
এরপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুগে তালেবান বিষয়ে নমনীয়তা অবলম্বন করে আমেরিকা। আফগানিস্তানে আমেরিকার দীর্ঘ অবস্থানে আর্থিক ক্ষতির দিকটাও এর অন্যতম কারণ। ২৮ অক্টোবর ২০১৮ মোল্লা বেরাদারকে মুক্তি দেয় পাকিস্তান। এরপর থেকে তিনি কাতারের দোহায় অবস্থিত তালেবানের কূটনীতিক অফিসে প্রধান হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। আমেরিকার শান্তিদূত জালমে খলিলজাদ দাবী করেন, আমেরিকার অনুরোধে বেরাদারকে মুক্ত করে পাকিস্তান। অবশ্য আফগান থেকে চলে যাওয়ার জন্য তালেবানের সাথে চুক্তি করতে বেরাদরের প্রয়োজন পরে আমেরিকার।
দোহার অফিস থেকে শান্তি আলোচনা অব্যাহত রাখেন তিনি। অবশেষে ফেব্রুয়ারি ২০২০ এ তালেবানের সাথে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি করে আমেরিকা। চুক্তিতে তালেবানের পক্ষ থেকে স্বাক্ষর করেন মোল্লা বেরাদার।
পরে আমেরিকার বাইডেন প্রশাসন আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সকল সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ১০ দিনের মধ্যে অবিশ্বাস্যভাবে পুরো আফগানিস্তানের দখল নেয় তালেবান। রবিবার (১৫ আগস্ট) কাবুল শান্তিপূর্ণভাবে জয় করলে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে তালেবান। কাবুলে অবস্থিত প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে তালেবান যোদ্ধারা অবস্থান নেওয়ার পর পদত্যাগ করে তাজিকিস্তান পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনী।
এরপর দীর্ঘ ২০ বছরের যুদ্ধ সমাপ্তির ঘোষণা দেয় তালেবান। তালেবান ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে তারা আফগানিস্তানে ইসলামি
ইমারাত প্রতিষ্ঠা করবে। কে হবে তালেবান সরকারের প্রধান তার সুস্পষ্ট ঘোষণা না আসলেও মোল্লা আব্দুল গনী বেরাদারের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে করেন কুটনৈতিক বিশ্লেষকরা।