ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর আমীর ও চরমোনাই পীর মুফতী মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, মেহমানকে আপ্যায়ন করা ইসলামের রীতি। এমনকি সে যদি আপন পিতার হত্যাকারীও হয় তবুও। এটা ইসলামের সৌন্দর্য্য। সে হিসেবে বাংলাদেশে আমন্ত্রিত সকল বিদেশি মেহমানদের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ স্বাগত জানায়। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিষয়টি আলাদা। তার সহিংস অতীত এবং ক্ষমতাগ্রহণের পরে ভারত জুড়ে তিনি যে ধর্মীয় সহিংসতা উস্কে দিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশে তাকে স্বাগত জানানোর মতো কোনো পরিবেশ নেই। নরেন্দ্র মোদি ভারতে বৈষম্য, সংখ্যালঘুদের ওপরে অত্যাচার-নিপীড়ন, ধর্মীয় তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মানুষকে পিটিয়ে মারা, কাশ্মীরের মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া এবং সিএএ-র মতো বর্ণবাদী আইন করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভারতে বসবাস করা মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার মতো কাজ করছে। একই সাথে তিনি প্রতিবেশিদের সাথে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী আচরণ করাসহ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার পরিপন্থী কার্যক্রমের প্রধান কুশিলবদের একজন। বাংলাদেশের সীমান্তে প্রতিনিয়ত মানুষ হত্যা, বাংলার মানুষের প্রাপ্য পানি নিয়ে অবৈধ কারসাজী, কুটকৌশলের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিক‚লে বাণিজ্য ঘাটতি জিইয়ে রাখা, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমÐলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং আগ্রাসী বিনিয়োগ করে বাংলাদেশকে দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি গ্রহনে বাধ্য করা; ইত্যাদি কারণে নরেন্দ্র মোদিকে বাংলার মানুষ স্বাগত জানাতে পারে না। নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে আমন্ত্রিত হওয়ার নৈতিক যোগ্যতা রাখেন না। বরং নরেন্দ্র মোদির মতো উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই মাইলফলকে উপস্থিত থাকা স্বাধীনতার মূল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক।
মঙ্গলবার (২৩ মার্চ) বেলা ১২টায় রাজধানীর পুরানা পল্টনস্থ ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
চরমোনাই পীর বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে তাদের দলীয় উৎসবে পরিণত করেছে। সরকার দমন-পীড়ন, হামলা-মামলা দিয়ে জনতার মাঝে বিভেদ তৈরি করে রেখেছে। একটি জাতীয় আনন্দঘন মুহুর্তকে এভাবে দলীয়করণ করার নিন্দা জানাচ্ছি। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর আনন্দমুখর মুহুর্তে সরকার দেশের রাজধানীতে সকল প্রকার সম্মিলিত ও প্রকাশ্য কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে কেবল রাষ্ট্রীয় এবং সরকার দলীয় অনুষ্ঠানে পরিণত করেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর মুহুর্তে এমন নিষেধাজ্ঞা স্বাধীনতার মৌলিক চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। মানুষের রক্তে কেনা স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনে সরকারের এমন বিধি-নিষেধ অত্যন্ত নিন্দনীয়। অবিলম্বে সকল বিধি-নিষেধ তুলে নিতে হবে।
তিনি বলেন, এদেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ একত্রে বসবাস করেছে। তাদের মাঝে সামাজিক ঝগড়া, ফাসাদ হলেও ধর্মকে কেন্দ্র করে গণ সাম্প্রদায়িকতা হয়নি। এমনকি এখানে গণধর্মান্তর ঘটেছে কোনো ধরণের সহিংসতা ছাড়া। হিন্দু প্রধান বাংলা মুসলিম প্রধান হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবেই। সেই বাংলায় ইংরেজ আগমণের পর থেকে শুরু হয়ে সম্প্রতি সুনামগঞ্জের শাল্লা অবধি নানা সময়ে কথিত সাম্প্রদায়িক হানাহানির কথা শোনা যায় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে মুসলমান ও ইসলামপন্থীদের ওপরে দায় চাপানো হয়।
তিনি বলেন, কথিত সাম্প্রদায়িক হানাহানির প্রত্যেকটি ঘটনায় কিছু মিডিয়াতে প্রচুর পরিমানে তথ্য বিকৃতির ঘটনা ঘটে এবং প্রতিবারই ইসলামপন্থীদের ওপরে দায় চাপিয়ে স্বার্থান্বেষীরা স্বার্থ হাসিল করতে চায়। শাল্লাতেও একই নাটকের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। অনতিবিলম্বে কায়েমী স্বার্থবাদী বলয়ের বাইরের উলামায়ে কেরাম, সংখ্যালঘু প্রতিনিধিসহ সর্বস্তরের নাগরিকদের নিয়ে একটি নাগরিক তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনার পেছনের স্বার্থান্বেষী অশুভচক্রকে খুঁজে বের করে শাস্তির মুখোমুখী করুন। অন্যথায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এমন একটি গণ-নাগরিক তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রকৃত অপরাধীদের সামাজিক বিচারের মুখোমুখী করবে, ইনশাআল্লাহ।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য প্রসঙ্গে মুফতী রেজাউল করিম বলেন, রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য হলো, মানুষের খাদ্য সরবরাহ ঠিক রাখা এবং তা ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা। দুঃখের সাথে বলতে হয়, সরকার এ ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম এখন আকাশচুম্বী। প্রতিদিন দাম বাড়ছে। সম্প্রতি কোনো কোনো পণ্যের দাম অল্প দিনের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সীমিত আয়ের মানুষ তাদের খাদ্য তালিকা থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান বাদ দিয়ে কোনমতে জীবন যাপন করছে। চাল-ডাল, সবজী ও তেলের দাম মানুষের নাগাল ক্ষমতার বাইরে। গরুর গোস্ত কিনে খাওয়া এখন সাধারণ মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো। মুরগিও এখন নাগালের বাইরে চলে গেছে। সামনে রমজান। রমজানে সমগ্র মুসলিম দেশে নিত্যপণ্যের দাম কমানো হয়। আর বাংলাদেশে দাম বাড়ানোর কুৎসিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়। দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ার পেছনে দ্রব্যের দুঃপ্রাপ্যতা নয় বরং সরকারের অব্যবস্থাপনায় চাঁদাবাজী, সিন্ডিকেট, অবৈধ কারসাজি ও মজুতদারিই প্রধানত দায়ী। সরকারের উচিৎ এগুলো বন্ধ করে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, সরকারই অনেক ক্ষেত্রে এসব অবৈধ কারসাজির সাথে জড়িত। আমরা অনতিবিলম্বে বাজার নিয়ন্ত্রণের দাবী জানাচ্ছি। যে করেই হোক, দ্রব্যমূল্যকে জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখুন।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫০ তম বছরে এসেও বাংলাদেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার পায়নি, আজও সরকার পরিচালনায় জনমতকে বুটের তলায় পিষে ফেলা হয়। বিগত জাতীয় নির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার যা করেছে, তাতে স্বাধীনতার মর্ম বিচ্যুত হয়েছে। আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার মহড়া শুরু করেছে।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, যে জাতি মাত্র ৯ মাসে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সে জাতিকে কেন ৫০টি বছর দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের দেশের সীমানায় আটকে থাকতে হলো? কেন বাংলাদেশ উন্নত দেশ না হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হচ্ছে? জরিপ বলছে, দেশে অতি-গরীব মানুষের সংখ্যা পৌনে ২ কোটি; ১০ ভাগ ধনী মানুষের আয় দেশের মোট সম্পদের ৩৮ ভাগ, আর ১০ ভাগ গরীব মানুষের আয় দেশের মোট সম্পদের ১ ভাগেরও কম। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম এর সর্বশেষ সামাজিক উত্তরণ সূচকে বাংলাদেশ ৮২ টি দেশের মধ্যে ৭৮ তম স্থানে। অর্থাৎ সবার জন্য সুষম উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো তলানির দেশগুলোর একটি। দেশের ৩৯ ভাগ ¯œাতকোত্তর বেকার। বিশ্বব্যাংকের মানবসম্পদ সূচকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের শিশুরা তার সম্ভাবনার মাত্র ৫০ ভাগ কাজে লাগাতে পারছে। বাকি অর্ধেক সম্ভাবনাই নষ্ট হচ্ছে। ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের করা গণতান্ত্রিক সূচকে বাংলাদেশ ৮৮তম, মানব সম্পদ সূচকে ১২৩ তম, মানব উন্নয়ন সূচকে ১৩৫ তম, বিশ্ব ব্যাংকের বানিজ্য সহজিকরণ সূচকে ১৬৮ তম, দূষিত বায়ুর সূচকে ১ম, দূর্নীতিতে ১৪ তম, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৫১ তম।
তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিক সূচক উপস্থাপন করি তাহলে দেখা যাবে, সকল ইতিবাচক সূচকে বাংলাদেশ তলানীতে আর নেতিবাচক সূচকে বাংলাদেশ শীর্ষে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এই হলো বাস্তবতা। এমন পরিস্থিতি কাম্য ছিলো না। আজকের এই আনন্দঘন উৎসবমুখর ক্ষণে দাড়িয়ে কারো প্রতি কোন অভিযোগ না করে, যারা অতিতে ভালো কাজ করেছেন, তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আর যারা খারাপ কাজ করেছেন, তাদের বিচার জনগণের হাতে ছেড়ে দিচ্ছি। পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণে বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিধৌত ইসলামী মূলনীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার করছে। দেশকে সুখি সমৃদ্ধ উন্নত দেশে পরিণত করার প্রতিজ্ঞা করছে এবং দেশ থেকে দূর্নীতি, দুঃশাসন, অন্যায় ও অবিচার দূর করে ইসলামের সুমহান আদর্শের আলোকে দেশকে সবার জন্যে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে ৮দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ১. ২৬ মার্চ ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলা/মহানগর, উপজেলা ও ইউনিয়নে পতাকা র্যালী। ২. মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা প্রদান ৩. দেশের প্রতিটি জেলায় মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে আলোচনা সভা, সেমিনার আয়োজন ৪. মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি শীর্ষক শ্বেতপত্র প্রকাশ ৫. আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর ইশতেহার প্রকাশ ৬. মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ দুআ মাহফিল ৭. ভোটাধিকারসহ জনগণের অন্যান্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় জনসচেতনতা তৈরী ৮. বৈষম্যহীন, সুখী-সমৃদ্ধ ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জনমত গড়ে তোলা।










