ইস্তাম্বুল মেয়র আকরাম ইমামোগলুর গ্রেফতারে গত এক দশকের সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ দেখছে তুরস্ক।
সোমবার (২৪ মার্চ) নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ৫ম দিনের মতো বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে ইমামোগলুর সমর্থক ও বিক্ষুব্ধ জনতা।
দেশটির স্বররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে জানানো হয়, ৫দিন যাবত চলমান বিক্ষোভ থে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ১৩৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়, গত এক দশকের সবচেয়ে বিক্ষোভ সামলাতে হচ্ছে তাদের। রাস্তায় সমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন জায়গায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটছে। এখন পর্যন্ত ১২৩ জন পুলিশ আহত হয়েছে।
স্বররাষ্ট্র মন্ত্রী আলি ইয়ারলিকায়া বলেন, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের অধিকার রয়েছে সবার। কিন্তু রাস্তায় সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের অবতারণা ঘটলে একে মোটেও প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।
দেশটির সাংবাদিক ইউনিয়ন জানায়, বিক্ষোভকারীদের মধ্য থেকে ৯জন সাংবাদিককেও আটক করেছে প্রশাসন। তন্মধ্যে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপির আলোকচিত্রীও রয়েছেন। আটককৃত সাংবাদিকরা বিভিন্ন শহরে চলমান বিক্ষোভ কভার করছিলেন।
সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে গত বুধবার তুরস্কের সবচেয়ে বড় শহর ইস্তাম্বুলের মেয়র ইমামোগলুকে গ্রেফতার করা হয়। বাতিল করা হয় তার উচ্চশিক্ষার সনদ।
এসবের মধ্যে তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, ইতোপূর্বে মার্কিন সহায়তা পাওয়া কুর্দিদের পিকেকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সহায়তা করা। যারা তুর্কি-সিরিয়া সীমান্ত এলাকায় দীর্ঘদিন যাবত কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবীতে তুরস্কের বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাসবাদী হামলা পরিচালনা করে আসছে।
সিরিয়া অংশের কুর্দিরা সম্প্রতি যাবতীয় অধিকার লাভ ও দেশটির মূলধারার সাথে একীভূত হওয়ার বিনিময়ে কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী ও সশস্ত্র আন্দোলন থেকে ফিরে আসে। কিন্তু তুরস্ক অংশের বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দিদের বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত রূপ লাভ করেনি। তা সত্ত্বেও তারা তুরস্কের হাতে আটক থাকা তাদের প্রভাবশালী কুর্দি নেতার কথায় সিরিয় কুর্দিদের ন্যায় অস্ত্র নামিয়ে রাখতে সম্মত হয়।
প্রকৃতপক্ষে সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখলে নেওয়া ইসরাইল সম্প্রতি সিরিয়ায় পুনরায় নতুন গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। বাশার বাহিনীকে দিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলে বিদ্রোহ শুরু করানো গেলেও কুর্দি ও দ্রুজ সম্প্রদায়কে দিয়ে তাদের দাবী বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার সরাসরি প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হয়।
সিরিয় কুর্দি ও দ্রুজরা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় তারা তাদের বিপ্লবোত্তর প্রেসিডেন্ট আহমদ শর’আর উপর আস্থা রাখবেন। সফলভাবে চুক্তিও সাক্ষর করে বাশার বিরোধী ও স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র আন্দোলনে সরাসরি আমেরিকার সহায়তা পাওয়া কুর্দিরা। অপরদিকে বাশার বাহিনীর বিদ্রোহীদের কঠোরভাবে দমন করেন আহমদ শর’আ।
ইসরাইল তাদের ষড়যন্ত্র ও অপচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সরাসরি তুরস্কের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে আমেরিকাকে হস্তক্ষেপের আহবান জানায়। সিরিয়ায় তুরস্কের প্রভাব ও সহায়তা বাড়তে থাকায় আমেরিকাকে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানায়।
এর ক’দিন পরই আমেরিকা-ইউরোপের সমর্থন প্রাপ্ত সেক্যুলার রাজনৈতিক দল সিএইচপির নেতা ও ইস্তাম্বুল মেয়র ইমামোগলুর কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পিকেকের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায় তুরস্ক।
রবিবার এক সাক্ষাতকারে আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল দূত উইটকফ জানান, তুরস্ক থেকে ভালো সংবাদের অপেক্ষা করছেন তারা। সবকিছু তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক আগাচ্ছে। তবে বিষয়টিকে তিনি আর স্পষ্ট করেননি।
বুধবার গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে তিনি তার সমর্থক ও জনগণের উদ্দেশ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে বার্তা দিয়ে যান। যেখানে তিনি লিখেন, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার এবং তুরস্কের জনগণের জন্য তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকবেন।
গ্রেফতারের পর তার এক্স একাউন্টে নিজ হাতে লেখা একটি নোটও পোস্ট করা হয়। যেখানে তিনি লিখেন, তুরস্কের জনগণ তার বিরুদ্ধে মিথ্যা, ষড়যন্ত্র ও ফাঁদের জবাব দিবে।
আরেকটি রেকর্ডেড ভিডিও বার্তায় এরদোগানের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, জনগণের ইচ্ছাকে নীরব রাখা যাবে না।
এছাড়া রবিবার আদালত তাকে কারারুদ্ধ রাখার আদেশ দিলে তিনি সংবাদমাধ্যমের সামনে প্রথমবারের মতো আনিত অভিযোগের ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্য দেন। বক্তব্যে তিনি তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলোকে অপবাদ ও অকল্পনীয় বলে আখ্যায়িত করেন।
এরদোগানের একেপির প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল সিএইচপি শক্তিশালী বিক্ষোভ গড়ে তুলতে উল্টো এরদোগান সরকারের বিরুদ্ধেই ইসরাইলকে সহায়তার প্রচারণা চালায়। যা দেশটির জনগণকে এরদোগানের বিরুদ্ধে প্রচুর বিক্ষুব্ধ করে তোলে।
এছাড়া আটকের ২দিন পর ২০২৮ এর নির্বাচনের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে ইমামোগলুর নাম ঘোষণার কথা ছিলো সিএইচপির। এর আগে পরীক্ষামূলক একটি ভোটেরও আয়োজন করে দলটি। যেখানে ১কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ ইমামোগলুকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে চান মর্মে ভোট পড়ে।
আটককে ঘিরে ইমামোগলুর বার্তা ও আটকের আগে-পরের নির্বাচনী যোগসূত্রও জনগণের বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠার আরেকটি বড় কারণ। কেননা ঐতিহ্য মোতাবেক সাধারণত ইস্তাম্বুলের মেয়রকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়ে থাকে দেশটির জনগণ।
এমন পরিস্থিতিতে জালিয়াতির অভিযোগে ইমামোগলুর স্নাতকের শিক্ষা সনদ বাতিলও বড় ধাক্কা হয়ে আসে। কেননা তুরস্কের সংবিধান মতে স্নাতক/স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা ছাড়া কেউ প্রেসিডেন্ট পদের জন্য দাঁড়াতে পারেন না। অথচ ইমামোগলুকেই এরদোগানের শক্তিশালী বিকল্প মনে করছে দেশটির জনগণ। কেননা সাংবিধানিক আইন পরিবর্তন করা ছাড়া সামনের নির্বাচনে আর প্রেসিডেন্ট পদের জন্য দাঁড়ানোর সুযোগ নেই এরদোগানের।
তাই ২২ বছর যাবত ক্ষমতায় থাকা এরদোগান পুনরায় ক্ষমতায় আসতে তার সম্ভাব্য শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ইমামোগলুকে গ্রেফতার করেছেন বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। বিক্ষোভকারীরা এরদোগান তুমি এক নায়ক ও ইমামোগলু তুমি একা নও স্লোগানে রাজপথ কাঁপিয়ে তুলছেন।
তুরস্কে সর্বশেষ এধরণের বড় বিক্ষোভ দেখা গিয়েছিলো ২০১৩ সালে। যা ২৮ মে থেকে শুরু হয়ে ২০ আগস্ট পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিলো। বিক্ষোভটি ‘গাজী পার্ক বিক্ষোভ’ নামে পরিচিতি পেয়েছিলো। সেই বিক্ষোভে ২২ জন নিহত ও প্রায় ৮ হাজার জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিলো। শুধু ইস্তাম্বুলেই ৭৫ লাখেরও বেশি তুর্কি সেই বার সরকারের ‘গাজী পার্ক’ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেছিলো। এরদোগান ছিলেন তখন দেশটির প্রধানমন্ত্রী।
সূত্র: মিডল ইস্ট মনিটর, বিবিসি