পরিবেশ সংরক্ষণের কথা বলে মুসলমানদের সূর্য, নদী ও গাছ পূজার পরামর্শ ইসলামের তাওহীদের আকীদার বিরুদ্ধে বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি মাওলানা মাহমুদ মাদানী। উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএসের সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবালের এ ধরনের বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন।
এক বিবৃতিতে মাওলানা মাদানী বলেন, তাওহীদ হলো আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস এবং একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত। ইসলামের মূল শিক্ষা এই যে, ইবাদত কেবল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। তাই পরিবেশ রক্ষার অজুহাতে প্রকৃতির উপাদানকে ইবাদতের পর্যায়ে তোলা মুসলিম ঈমান ও আকীদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এর আগে গোরখপুরে এক হিন্দু সম্মেলনে বক্তব্য দিতে গিয়ে আরএসএসের সাধারণ সম্পাদক হোসাবালে দাবি করেন, প্রকৃতির প্রতি সম্মান ধর্মীয় সীমানা ছাড়িয়ে যায়। তিনি বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণকে এগিয়ে নিতে নদী, গাছ ও সূর্যের প্রতি শ্রদ্ধা দেখালে মুসলমানদের কিছুই হারাতে হবে না। তিনি আরও প্রশ্ন তোলেন, যারা নামাজ আদায় করেন, তারা যদি পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে নদীকেও পূজা করেন, তাহলে এতে ক্ষতি কী। ভারতের ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ক্ষতিহীন সাংস্কৃতিক চর্চা হিসেবে তিনি বিষয়টিকে উপস্থাপন করেন।
মাওলানা মাদানী বলেন, ভারতে হিন্দু ও মুসলমান শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একসঙ্গে বসবাস করে এসেছে। তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার পরও আরএসএসের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা ইসলাম ও মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস বোঝার বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেখাননি, অথচ তাওহীদের বিশ্বাস কোনো বিচক্ষণ বা শিক্ষিত মানুষের কাছে অজানা নয়।
ইসলামের অবস্থান স্পষ্ট করে তিনি বলেন, তাওহীদ ও নবুওয়তের প্রতি বিশ্বাসই ইসলামের ভিত্তি, এবং এই নীতিমালা থেকে সামান্য বিচ্যুতিও একজন মানুষকে ঈমানের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়। তিনি বলেন, ভূমি, প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভালোবাসা এবং সেগুলো রক্ষায় চেষ্টা করা আমানতদারির দায়িত্ব, কিন্তু তা ইবাদত নয়। একত্ববাদের ওপর অটল ভারতীয় মুসলমানদের সূর্য, পৃথিবী, নদী বা গাছ পূজার আহ্বান দিয়ে আরএসএস শ্রদ্ধা আর ইবাদতের মৌল পার্থক্যই গুলিয়ে ফেলছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মাওলানা মাদানী বলেন, এ ধরনের বক্তব্য আরএসএস দেশের জন্য জাতীয় দিকনির্দেশনা দেওয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক সক্ষমতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে, অথবা ভারতের বহুত্ববাদী বাস্তবতার সঙ্গে দায়িত্বশীলভাবে যুক্ত হতে অনিচ্ছার ইঙ্গিত দেয়।
তিনি বলেন, পারস্পরিক সম্মান, সংলাপ এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ধারাবাহিকভাবে কাজ করে এসেছে। আরএসএস নেতৃত্ব ও হিন্দুত্ববাদী ধারা সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ইসলাম ও মুসলমানদের বিষয়ে ভুল ধারণা দূর করতে জমিয়ত আন্তরিক চেষ্টা করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
মাওলানা মাদানীর ভাষ্য, অতীতে আরএসএসের সাবেক সরসংঘচালক কে এস সুদর্শনসহ অন্যদের সঙ্গে সংলাপ হয়েছিল, এবং আজও অর্থবহ ও আন্তরিক সংলাপের জন্য জমিয়ত উন্মুক্ত।
তবে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, গঠনমূলকভাবে যুক্ত হওয়ার বদলে আরএসএসের কিছু কর্মী ক্রমেই উসকানিমূলক ও বর্জনমূলক পথ নিচ্ছে। তিনি বলেন, অন্য ধর্মের অনুসারীদের ওপর নিজেদের উপাসনার ধরন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও দেখা যাচ্ছে, যা গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী সমাজে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
মাওলানা মাদানী বলেন, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নীতিগত অবস্থান হলো, ভারতে জাতিসত্তার ভিত্তি দেশ। ধর্ম বা বিশ্বাস নির্বিশেষে এ দেশের সব নাগরিক এক জাতি। তিনি বলেন, জমিয়ত যৌথ ভূখণ্ড ও যৌথ জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতিসত্তাকে দেখে, কিন্তু আরএসএস একটি মাত্র গোষ্ঠী এবং নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে তা সংজ্ঞায়িত করতে চায়।
ড. বি আর আম্বেদকরের কথা উল্লেখ করে মাওলানা মাদানী বলেন, তিনি ভারতকে বহু সংস্কৃতি ও বহু সভ্যতার দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, এটি কোনো একরূপ সমাজ নয়। তাই এক সংস্কৃতি বা এক সম্প্রদায় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হতে পারে না। জাতিসত্তার একমাত্র বাস্তবসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভিত্তি হলো যৌথ ওতন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বিবৃতিতে মাওলানা মাহমুদ মাদানী বলেন, ভারত যদি এগিয়ে যেতে চায় এবং উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়, তাহলে জাতীয় ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আরও শক্ত করা জরুরি। তিনি বলেন, এর জন্য আন্তরিক সংলাপ, পারস্পরিক সম্মান এবং সংবিধানিক মূল্যবোধ ও বহুত্ববাদ রক্ষায় বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।
সূত্র : মুসলিম মিরর











