পাকিস্তানের আইএসপিআরের মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমদ শরীফ চৌধুরী কারাবন্দি দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় অভিযোগ করেছেন। তার দাবি, ইমরান খান একটি “সেনাবাহিনী-বিরোধী” বয়ান তৈরি ও ছড়িয়ে দিচ্ছেন এবং এ ধরনের বয়ান এখন রাজনীতির পরিধি ছাড়িয়ে জাতীয় নিরাপত্তার হুমকিতে পরিণত হয়েছে।
শুরকবার (৫ ডিসেম্বর) রাওয়ালপিন্ডিতে সিনিয়র সাংবাদিক ও অ্যাঙ্কর পার্সনদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত আইএসপিআরের এক প্রেস কনফারেন্সে এসব কথা বলেন ডিজি আইএসপিআর লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমদ শরীফ চৌধুরী।
প্রেস কনফারেন্সের শুরুতেই তিনি বলেন, একটি ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি তৈরি হয়েছে, যা সেনাবাহিনীর জন্য মোকাবিলা করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
ইমরান খানকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, এই হুমকি আসে একজন বিভ্রমগ্রস্ত ব্যক্তির বিভ্রমগ্রস্ত মানসিকতা থেকে, যিনি নিজের অহংকারের বন্দী হয়ে ভাবেন, তার ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা পাকিস্তান রাষ্ট্রের চেয়েও বড়। তার ভাষায়, ওই ব্যক্তির অহংকার, ইচ্ছা ও হতাশা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তিনি মনে করেন, তাকে ছাড়া পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকবে না।
পাক সেনাবাহিনীর মুখপাত্র বলেন, তার মুখ থেকে এমন মন্তব্য “কিছুটা অদ্ভুত” মনে হতে পারে, কিন্তু যে বয়ান ওই ব্যক্তি চালাচ্ছেন, তা এখন আর রাজনীতি নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়।
তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর গণমাধ্যম শাখার জন্য খুবই জরুরি যে তারা সব দ্বিধা ও সংশয় দূর করে প্রয়োজনীয় সত্য কথা স্পষ্টভাবে বলবে। তার দাবি, এই বয়ান কীভাবে কাজ করছে এবং কীভাবে তা বাইরের শক্তির সঙ্গে গভীর যোগসাজশে কাজ করছে, তা বোঝা জরুরি।
ইমরানের বয়ান কীভাবে সশস্ত্র বাহিনীকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে সে বিষয়ে তিনি কয়েকটি দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে ফাটল ধরানোর সুযোগ কাউকে দেওয়া যাবে না, কারণ এটাই দেশের একমাত্র সশস্ত্র বাহিনী এবং এর কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, সেনাবাহিনী ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী মানসিকতা ও তাদের আধিপত্যবাদী পরিকল্পনার বিপরীতে জনগণের ঢাল। একই সঙ্গে তিনি বলেন, পাকিস্তানের জনগণ ও সন্ত্রাসবাদী হুমকির মাঝখানেও সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে তিনি খারেজি, সন্ত্রাসী, ফিতনা আল-খারেজি এবং আফগানিস্তান থেকে পরিচালিত ফিতনা আল-হিন্দুস্তান-এর উল্লেখ করেন। তার প্রশ্ন, যে ব্যক্তি নিজের সেনাবাহিনী ও তার নেতৃত্বকে আক্রমণ করে, সে কি অন্য কারও সেনাবাহিনীর জন্য জায়গা তৈরি করতে চাইছে।
পাক সেনাবাহিনীর মুখপাত্র বলেন, যখনই কেউ ইমরানের সঙ্গে দেখা করতে যায়, তখন আইন, সংবিধান ও নিয়মকে একপাশে রেখে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনী ও তার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একটি বয়ান খেলানো হয়। তিনি প্রশ্ন তোলেন, পাকিস্তানে কোন আইন, কোন নিয়ম বা কোন সংবিধান একজন দণ্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করে সেখান থেকে নিজের দেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ধারাবাহিক বয়ান তৈরিকে অনুমতি দেয়। এ প্রসঙ্গে তিনি পিটিআইয়ের দাবি উল্লেখ করেন যে তারা আদিয়ালা কারাগারে ইমরানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চায়। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ইমরান ২০২৩ সাল থেকে সেখানে বন্দি।
তিনি বলেন, সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বললেও সেখানে যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ আছে। তার বক্তব্য, ওই বিধিনিষেধের অধীনে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার বিরুদ্ধে কিছু অনুমোদিত হতে পারে না। একইভাবে তিনি বলেন, ১৯ অনুচ্ছেদে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা স্বীকৃত হলেও এমন বক্তব্য বা বয়ান অনুমোদিত হতে পারে না, যা পাকিস্তানের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা ও প্রতিরক্ষার বিরুদ্ধে যায়। তার প্রশ্ন, তাহলে কোন আইন বা বিধানের অধীনে একজন দণ্ডিত ব্যক্তি সেনাবাহিনী ও তার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বয়ান ছড়াতে পারেন।
পাক সেনাবাহিনীর মুখপাত্র অভিযোগ করেন, ইমরান দেশকে খেলাপিতে ঠেলে দিতে রেমিট্যান্স বন্ধ করার চেষ্টার মাধ্যমে এই বয়ান ছড়িয়েছেন। তিনি বলেন, ইমরান আইএমএফকে চিঠি লিখে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো চুক্তিতে না যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন যাতে রাষ্ট্র খেলাপি হয়ে যায়। তিনি আরও দাবি করেন, ইমরান নাগরিক অবাধ্যতা উসকে দিয়েছেন, বিদ্যুৎ বিল না দেওয়ার কথাও বলেছেন, যাতে দেশে বিশৃঙ্খলা ছড়ায়। তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে ইমরান তার অনুসারীদের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বকে টার্গেট করতে বলেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, ওই সেনাবাহিনী অপারেশন বুনইয়ানুম মারসুস ও মারকা-ই-হক-এ নিজেদের চেয়ে আট গুণ বড় অর্থনীতি ও সশস্ত্র বাহিনীর বিপরীতে দাঁড়িয়ে জাতির সম্মান অর্জন করেছে।
ডিজি আইএসপিআর আরও বলেন, পাকিস্তানে বসবাসকারী কেউ দেশের বিরুদ্ধে এমন এজেন্ডা রাখতে পারে না। তার বক্তব্য, এমন এজেন্ডা দিল্লি থেকে আসতে পারে, যেখানে কেউ বসে নির্দেশ দেয় এবং চায় যে সেনাবাহিনী, যারা খারেজি ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করছে, তারা যেন তা বন্ধ করে দেয়।
তিনি বলেন, পুরো প্রেস কনফারেন্সে ইমরানের নাম উচ্চারণ না করলেও তিনি নিজের বক্তব্যের পক্ষে ইমরানের সেনাবাহিনী-বিরোধী টুইটসম্বলিত একটি ভিডিও ক্লিপ দেখিয়েছেন। কিছু সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো কোথা থেকে চালানো হয় কেউ জানে না, পিটিআইও নাকি জানে না, কিন্তু এসব অ্যাকাউন্ট দিয়ে ছড়ানো বয়ানের মালিকানা তারা নেয়।
পাক সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ইমরানকে “মানসিক রোগী” আখ্যা দিয়ে বলেন, দুই দিন আগে ইমরানের এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে একটি টুইট পোস্ট করা হয়, যা কয়েক মিনিটে ভাইরাল হয়ে যায়। তার দাবি, বহু বেনামী ট্রল অ্যাকাউন্ট পাকিস্তানের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়ে ওই পোস্টকে ভাইরাল করে এবং এই বয়ানের উৎস ওই “মানসিক রোগী”-র পোস্ট।
তিনি বলেন, ভারতীয় মিডিয়া ও র-সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টগুলো এই পোস্ট ছড়াতে ভূমিকা রাখে। তার ভাষায়, ভারতীয় মিডিয়া সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই বয়ান প্রচার করে, কারণ ইমরান সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করেন।
তিনি আরও দাবি করেন, ”খারেজিদের সুবিধাদাতা” হিসেবে আফগান সোশ্যাল মিডিয়াও ইমরানের সেনাবাহিনী-বিরোধী বয়ান ছড়াতে জড়িত। তার ভাষায়, একাধিক পক্ষ একই সময়ে কাজ করে এবং পরে আন্তর্জাতিক মিডিয়াও এ ধরনের খবর তুলে নেয়। তিনি এটিকে উদ্দেশ্যগত যোগসাজশ বলে উল্লেখ করেন।
ইমরানের এনডিইউ-সংক্রান্ত কঠোর মন্তব্যের প্রসঙ্গে ডিজি আইএসপিআর বলেন, ইমরান যেভাবে তার দলের সদস্যদের বিশ্বাসঘাতক বলেছেন, সেই যুক্তিতে তিনি এমনও বোঝাতে চান যে আইএসপিআর ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত যে কেউই বিশ্বাসঘাতক। তিনি বলেন, ইমরান মনে করেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন ব্যক্তিও বিশ্বাসঘাতক।
পাক সেনাবার মুখপাত্র বলেন, মানুষকে দীর্ঘদিন বিভ্রান্ত করা সম্ভব নয়। তার ভাষায়, কিছু মানুষকে সবসময় এবং সবাইকে কিছু সময় বিভ্রান্ত করা যায়, কিন্তু সবাইকে সবসময় বিভ্রান্ত করা যায় না। তিনি বলেন, পিটিআইয়ের রাজনৈতিক ধোঁকাবাজির অবসান ঘটানোর সময় এসেছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, কেন পিটিআই সেনাবাহিনী নিয়ে এত কথা বলে অথচ খাইবার পাখতুনখোয়ার শাসনব্যবস্থা বা সন্ত্রাসবাদ দমনে তাদের কার্যক্রম নিয়ে যথাযথভাবে কথা বলে না।
সন্ত্রাসবাদ, আফগানিস্তান ও টিটিপি ইস্যুতে পিটিআইয়ের নীতির সমালোচনা করে তিনি প্রশ্ন করেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কি “সাবলেট” দেওয়া যায় এবং তোষণ কি নিরাপত্তা নীতি হতে পারে। তিনি কটাক্ষ করে বলেন, পাকিস্তানের নিরাপত্তা কি কাবুল বা নয়াদিল্লি নিশ্চিত করবে। তিনি উদাহরণ হিসেবে লিবিয়া ও গাজ্জার কথা উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, ইমরান ও পিটিআই কেন সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আলোচনার ডাক দেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বলেন, “প্রথমত, তিনি একজন মানসিক রোগী।” এরপর তিনি সন্ত্রাস-অপরাধ যোগসূত্র, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং কেপিতে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে শাসনব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন এড়াতে সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র করে বয়ান তৈরির অভিযোগ করেন।
ডিজি আইএসপিআর বলেন, মিথ্যা ও প্রতারণার এই ধারা আর চলতে দেওয়া হবে না। তার ভাষায়, কেউ যদি মনে করে তার ব্যক্তি ও রাজনীতি দেশের নিরাপত্তার চেয়ে বড়, তবে সে ভুল করছে। তিনি বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের সুরক্ষার শপথ নিয়েছে এবং দাঁড়িয়ে আছে, ভবিষ্যতেও দাঁড়িয়ে থাকবে।
সূত্র : ডন









