বিধ্বস্ত গাজ্জায় কোনো শান্ত রাত নেই; যুদ্ধবিরতির আগেও নয়, শার্ম আল শেখে শান্তি ঘোষণার পরেও নয়। অবরোধ শিথিল করলেও ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মারা যাচ্ছে নিরীহ অসহায় ফিলিস্তিনি নারী-শিশুরা।
সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক শান্তি আলোচনা ও মধ্যস্থতাকারী সাংবাদিক ‘লাবনা মাসারোওয়া’র একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে ব্রিটেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই।
ওই নিবন্ধে সাংবাদিক লাবনা মাসারোওয়া লেখেন, মিশরের সমুদ্রতীরবর্তী রিসোর্ট শার্ম-আল-শেখে যখন বিশ্ব নেতারা হাসছিলেন এবং গাজ্জায় যুদ্ধের সমাপ্তি সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে করমর্দন করছিলেন, তখন ইসরাইলি সেনাবাহিনী থেমে থেমে গাজ্জায় বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছিল; যেন তারা নিঃশ্বাস নেওয়ারও বিরতি দিতে চায়নি।
যুদ্ধবিরতির ঠিক একদিন পরেই ইহুদিবাদী সরকার ১০৪ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে; যার মধ্যে ৪৬ জন শিশু এবং একই পরিবারের ১৮ জন সদস্য রয়েছে। নিহতদের অনেকের নামও জানা যায়নি; তারা নীরবে এবং বেনামে শহীদ হয়েছেন।
বিশ্বের কাছে, ফিলিস্তিনিরা আর মানুষ নেই; তারা আবেগহীন, অতীতহীন, গল্পহীন এবং ভবিষ্যৎহীন প্রাণী হয়ে উঠেছে। ইসরাইলি গণমাধ্যম তাদের বন্দীদের জীবন সম্পর্কে, তাদের প্রিয় খাবার থেকে শুরু করে পরিবারের কাছে ফিরে আসার মুহূর্ত পর্যন্ত বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করলেও, গাজ্জার শহীদ শিশুদের জন্য কেউ চোখের জল ফেলে না।
যুদ্ধবিরতির দিন, ইসরাইলি টেলিভিশন একটি দৃশ্য সম্প্রচার করে; একজন ইসরাইলি বন্দির স্ত্রী তার পাঁচ বছরের ছেলেকে জাগিয়ে তুলে বলেন, তার বাবা ফিরে এসেছেন। এ সময় টিভি উপস্থাপকদের চোখে পানি ছিল। কিন্তু একই দিনে, ইসরাইলি সেনাবাহিনী পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি বন্দিদের বাড়িতে হামলা চালায়; যারা সেদিনই মুক্তি পেতে যাচ্ছিল। পরিবারগুলোকে হুমকি দেওয়া হয় যে, তাদের প্রিয়জনকে মুক্তি দেওয়া হলেও তাদের আনন্দ উদযাপন করার কোনো অধিকার নেই।
এক ফিলিস্তিনি বন্দির মেয়ে রাজান বলেন, সৈন্যরা আমাদের বাড়িতে হামলা চালিয়েছে, আমাদের হুমকি দিয়েছে এবং কাউকে আমার বাবাকে অভিনন্দন জানাতেও দেয়নি! ওই হামলায় এক যুবক আহত হয় এবং আরও বেশ কয়েকজনকে মারধর করা হয়।
হাইসাম সালেম নামে গাজ্জার এক ফিলিস্তিনি বন্দি তার মুক্তির পর জানতে পারেন যে, তার স্ত্রী এবং তিন সন্তান ইসরাইলি হামলায় শহীদ হয়েছেন। হাসপাতালে গিয়ে তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘আমার বাচ্চারা কি বেঁচে আছে? না… তারা মারা গেছে। অথচ আমার মেয়েটার জন্মদিন ছিল চার দিন পরে।’
সেই ফিলিস্তিনি ব্যক্তি কারাগারে বসে তার মেয়ের জন্য একটি ব্রেসলেটটি তৈরি করেছিলেন। সেটি তুলে ধরে বললেন, ‘আমি এটা তার জন্য তৈরি করেছি, নিজের হাতে।’
হাইসাম সালেমের মেয়েটি তার ছেলের সমান বয়সি ছিল। কয়েকদিন আগে ছেলেটি তার জন্মদিন উদযাপনও করেছিল। কিন্তু তার এখন কেউই জীবিত নেই। সেই সঙ্গে পরিবার-পরিজন হারানো সালেমের জন্য কেউ এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেলল না এবং তার মুক্তিকে স্বাগত জানাতেও কেউ বাকি রইল না।
ইসরাইল যখন তার (কথিত) ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ নিয়ে কথা বলছে, তখন কেউ গাজ্জা বা পশ্চিম তীরের মানুষকে রক্ষা করছে না। এমনকি ২০,০০০ শিশুসহ ৬৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির জীবনও বিশ্বকে নাড়া দিতে যথেষ্ট নয়।
যে ইসরাইল এক রাতে বোমা মেরে শত শত মানুষের জীবন কেড়ে নিতে পারে। সেই ইসরাইল আক্রমণের আগে কেবল আমেরিকাকে অবহিত করে এবং পরের দিন শিশুদের লাশ দাফন করার আগেই আবার ‘যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণা দেয়।
অন্যদিকে শার্ম আল-শেখ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারী সরকারগুলো ফিলিস্তিনিদের পরামর্শ দেয় যে, স্বাধীনতা অর্জনের একমাত্র উপায় হলো আলোচনা, প্রতিরোধ নয়। কিন্তু ইসরাইল দেখিয়েছে যে তারা কোনো চুক্তি মেনে চলবে না।
এদিকে গাজ্জায় ‘যুদ্ধোত্তর’ একটি নতুন মডেল রূপ নিচ্ছে; ইসরাইল দ্বারা পরিকল্পিত এবং আরব ও মুসলিম নেতাদের দ্বারা অনুমোদিত একটি মডেল, যেখানে ট্রাম্পের সঙ্গে হাসিমুখে করমর্দন করা হবে। এই মডেলে ‘প্রতিরক্ষার অধিকার’ কেবল ‘জানার অধিকার’-এর স্থানে প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
যার অর্থ বাস্তবে ইসরাইল যখনই চাইবে তখনই ফিলিস্তিনিদের হত্যা করবে, তবে নিরীহ ফিলিস্তিনিরা কিছু করা তো দূরে থাক, বলতেও পারবে না।









