ইন্তিফাদা বাংলাদেশ জুলাই ঘোষণাপত্রকে “বিকৃত, অসম্পূর্ণ ও জনবিচ্ছিন্ন” আখ্যা দিয়ে তা পুনর্লিখনের জোর দাবি জানিয়েছে। সংগঠনের মতে, এই দলিল জনগণের প্রকৃত সংগ্রাম, ইতিহাস ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং আওয়ামী জাহেলিয়াতের অপরাধকে ইচ্ছাকৃতভাবে আড়াল করেছে।
আজ শনিবার (৯ আগস্ট) বিকাল ৩টায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (শফিকুল কবির মিলনায়তন)–এ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ইন্তিফাদা বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আসিফ আদনান। তিনি জানান, ৫ আগস্ট মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস যে “জুলাই ঘোষণাপত্র” পাঠ করেন, তা জনগণের ঈমানী চেতনা, ত্যাগ ও সংগ্রামের সাথে সাংঘর্ষিক এবং ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলোকে আড়াল করেছে।
আসিফ আদনান বলেন, “ঘোষণাপত্রে উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের ধারাবাহিকতা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। ফকির মজনু শাহ, তিতুমীর, ফরায়েজি আন্দোলন কিংবা জমিদারবিরোধী কৃষক প্রতিরোধ—যা মুসলিম বাংলার রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তি তৈরি করেছিল—তার কোনোটির উল্লেখ নেই। দুই শতকের আত্মত্যাগকে একটি অস্পষ্ট বাক্যে সীমাবদ্ধ করা আত্মপরিচয়ের শেকড় কাটার শামিল।” তিনি বলেন, এই ইতিহাস উপেক্ষা মানে জনগণের আত্মপরিচয় ও অস্তিত্বকে দুর্বল করে দেওয়া।
তিনি উল্লেখ করে বলেন, “ব্রিটিশ আমলে গড়ে ওঠা শোষণমূলক প্রশাসনিক, বিচারিক ও সামরিক কাঠামো ভেঙে ফেলার প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এই কাঠামো অক্ষত থাকলে নাগরিক অধিকার কাগজে থাকবে, বাস্তবে থাকবে না।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এই কাঠামোর বিউপনিবেশায়ন অপরিহার্য।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের জন্ম ১৯৪৭ সালের মুসলিম সংখ্যাগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামের ফসল। কিন্তু ঘোষণাপত্রে সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রাধান্য দিয়ে ৪৭-কে বাদ দেওয়া হয়েছে। এটি মূলত মুজিববাদী ইতিহাসচর্চার পুনরাবৃত্তি।” তার মতে, ৪৭-এর ভূমিকা বাদ দেওয়া মানে বাংলাদেশের ভিত্তি ভেঙে দেওয়া।
আসিফ আদনান বলেন, “ঘোষণাপত্রে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে ‘উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা একটি চরম বিকৃতি। বাস্তবে এটি ছিল ঈমান, ইনসাফ ও মর্যাদার জন্য শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ—পশ্চিমা লিবারেল-ডেমোক্রেসি চাপিয়ে দেওয়ার কোনো প্রচেষ্টা নয়।” তিনি বলেন, জনগণের সংগ্রামকে সেক্যুলার বয়ানে বাঁধা তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতি অবমাননা।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, “১৯৭২ সালের মতো এবারও জনগণের মতামত বাদ দিয়ে এলিট শ্রেণির মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়নের চেষ্টা চলছে। ‘বহুত্ববাদ’-এর নামে সেক্যুলার আদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট।” তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়া জনগণের অংশগ্রহণহীন একটি চাপিয়ে দেওয়া কাঠামো তৈরি করবে।
তিনি বলেন, “৭ নভেম্বর ১৯৭৫-কে ‘বিপ্লব’ বলা অতিরঞ্জন এবং ২০২৪ সালের জুলাইকে ‘গণঅভ্যুত্থান’ বলায় এর গুরুত্ব খাটো করা হয়েছে। এ ধরনের পক্ষপাতমূলক ভাষা দলিলের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে।” তিনি উল্লেখ করেন, ইতিহাসকে সঠিকভাবে না বললে তা ভবিষ্যত প্রজন্মকে ভুল পথে পরিচালিত করবে।
তিনি উল্লেখ করে বলেন, “আওামী ফ্যাসিবাদের পেছনে শুধুমাত্র দল নয়—প্রগতিশীল, বামপন্থী, সুশীল সমাজ, মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ঘোষণাপত্রে এসব আড়াল করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে একই কাঠামো পুনরায় টিকে থাকার ঝুঁকি রাখে।” তার মতে, ফ্যাসিবাদ ভাঙতে হলে এর প্রতিটি স্তম্ভ চিহ্নিত করা জরুরি।
তিনি বলেন, “সরকারি গেজেট ও জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তথ্যের মধ্যে বড় অসঙ্গতি আছে। বহু শহীদের মরদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হলেও এখনো কোনো তদন্ত বা স্বীকৃতি মেলেনি।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই সংখ্যা নির্ধারণ রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।
তিনি বলেন, “পিলখানা হত্যাকাণ্ড, সীমান্ত হত্যা, তিস্তার পানি আটকে রাখা, ভুয়া নির্বাচনে সমর্থন এবং গণঅভ্যুত্থানের পর হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার মতো অপরাধে ভারতের ভূমিকা আড়াল করা হয়েছে। ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল ভারতীয় আধিপত্য থেকেও মুক্তির সংগ্রাম।” তিনি অভিযোগ করেন, আক্রমণকারী রাষ্ট্রের নাম উল্লেখে সাহস না থাকলে দলিল জনগণের প্রতিনিধি হতে পারে না।
তিনি বলেন, “ঘোষণাপত্রে সব সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠনের ঐক্যের দাবি বাস্তবতা বিরোধী। ইসলামী অনুপ্রেরণায় জনগণ মাঠে নামলেও অমুসলিম সংগঠনগুলোর ভূমিকা ছিল নগণ্য এবং অনেকেই আওয়ামী দখলদারিত্বের পক্ষে ছিল।”
তিনি বলেন, “র্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআই, সিটিটিসি, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ভূমিকা স্পষ্ট উল্লেখ না করে ‘ফ্যাসিবাদী বাহিনী’ শব্দে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে, যা অপরাধীদের দায় ঝাপসা করে।” তিনি বলেন, অপরাধী বাহিনীর নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হওয়া জরুরি।
তিনি বলেন, “পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাহবাগ আন্দোলন, শাপলা চত্বর, কোটা সংস্কার, নিরাপদ সড়ক, মোদীবিরোধী আন্দোলন ও ইসলামপন্থীদের ত্যাগের কথা ঘোষণাপত্রে বাদ দেওয়া হয়েছে।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ ও ‘টেকসই উন্নয়ন কৌশল’-এর মতো জাতিসংঘ-এনজিও পরিভাষা ব্যবহার করে পশ্চিমা এজেন্ডা চাপানোর শঙ্কা আছে। পাশাপাশি ‘যেহেতু–সেহেতু’ শব্দের অতিরিক্ত ব্যবহার দলিলকে সাধারণ মানুষের জন্য দুর্বোধ্য করে তুলেছে।”
আসিফ আদনান বলেন, “এই ঘোষণাপত্র বাংলার মানুষের সংগ্রাম, চেতনা ও ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ২৪ নম্বর পয়েন্টে উল্লিখিত জুলাই যোদ্ধাদের নিরাপত্তার বিষয় ছাড়া বাকি সব প্রস্তাব বাতিল করে পুনর্লিখন করতে হবে।”
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ইন্তিফাদা বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য মাওলানা মীর ইদররীস নদভী, হাফেজ আবু তাসমিয়া রফিকুল ইসলাম, ডাক্তার শামসুল আরেফীন শক্তি, জাকারিয়া মাসউদ প্রমুখ।









