অবৈধ মনে হলেই অভিবাসীদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে আসামের প্রাদেশিক সরকার।
বৃহস্পতিবার (১২ জুন) মুসলিম মিররের খবরে একথা জানানো হয়।
খবরে বলা হয়, আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা বুধবার জানিয়েছেন, অবৈধ অভিবাসী হিসেবে সন্দেহভাজন হলেই অভিবাসীদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে, যদিও তাদের নাম জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (NRC)-এ অন্তর্ভুক্ত থাকে।
গত মঙ্গলবার এমন ১৯ জনকে সীমান্ত এলাকা থেকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আসাম সরকার এই প্রক্রিয়া চলমান রাখবে। তার সরকার এমন আরো ৯ জনকে বুধবার বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর চিন্তাভাবনা করছে বলেও জানান।
NRC -তে নাম থাকা সত্ত্বেও অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বিবেচনার কারণ স্বরুপ তিনি বলেন, অনেকে চালাকি করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নিজেদের নাম NRC-তে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এক জেলার লোকদের অন্য জেলায় নিয়ে এসে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক দেখাচ্ছে।
NRC -র নিবন্ধন প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, অনেক চালাকি করে অনেকের নাম NRC-তে ঢোকানো হয়েছে, যার ফলে এর বিশ্বাসযোগ্যতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। এক্ষেত্রে অবশ্য দু’পক্ষেরই ভুল হয়েছে। তবে যারা প্রতারণা করেছে তারা আমাদের জনগণকে ঠকানোর জন্য অত্যন্ত চতুর।
এক্ষেত্রে তিনি হর্ষ মন্দার নামক এক সরকারি কর্মকর্তা ও মানবাধিকার কর্মীর উদাহরণ টেনে আনেন, যিনি মূলত দিল্লির বাসিন্দা এবং আসামে ২ বছর অবস্থান করেছেন। তিনি NRC ও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে আসামে দীর্ঘদিন কাজ করে আসছিলেন।
হর্ষ মন্দারের বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ করে বলেন, এই ব্যক্তি কয়েকজন যুবককে আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যে নিয়ে গিয়ে শিখিয়েছেন যে কীভাবে NRC-কে ‘ম্যানিপুলেট’ করা যায়। কিন্তু সরকার এই ‘ষড়যন্ত্র’ সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ ছিলো। কখনো ভাবেওনি যে এটি এমন পর্যায়ে পৌঁছবে। তাই আমি অত্যন্ত জোর দিয়েই বলতে চাই, ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি না যে NRC-তে কারো নাম থাকা মানেই সে এখানকার বৈধ নাগরিক।
এই অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় হর্ষ মন্দার নামের সেই সরকারি কর্মকর্তা বলেন, নাগরিকত্বের প্রশ্নে লোকজনকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে কাজ করায় আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলেছেন, তিনি আমাকে জেলে পাঠাবেন। আমি এতে মোটেও বিচলিত নই। বরং আমি আমাদের প্রচেষ্টার জন্য গর্বিত। কারণ আমি ও আমার টিম যারা অনির্দিষ্টকাল ধরে অমানবিক অবস্থায় ডিটেনশন সেন্টারে আটক ছিলেন, তাদের মুক্তির জন্য কাজ করেছি।
তিনি আরো বলেন, যদি এটি অপরাধ হয়, তাহলে মুখ্যমন্ত্রী সাহেব আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক।
সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, ২০১৯ সালের আগস্টে আসাম সরকার রাজ্যের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন NRC প্রকাশ করে, যার উদ্দেশ্য ছিলো ভারতীয় নাগরিকদের থেকে এমন অভিবাসীদের পৃথক করা যাদের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে বাসিন্দাদের প্রমাণ করতে হতো যে তারা বা তাদের পূর্বপুরুষরা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ রাতের আগে আসামে এসেছিলেন।
এই NRC তালিকা থেকে আসামের প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ বাদ পড়েন, যা মোট আবেদনকারীর ৫.৭৭ শতাংশ।
অক্টোবরে, সুপ্রিম কোর্ট ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ধারা-৬ অনুচ্ছেদ-এ কে সংবিধান সম্মত ঘোষণা করে। এই ধারা ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তির ভিত্তিতে চালু হয়েছিলো, যা জানুয়ারি ১, ১৯৬৬ থেকে ২৫ মার্চ, ১৯৭১-এর মধ্যে আসামে প্রবেশকারী বিদেশিদের ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ দেয়।
তবে আসামের আদিবাসী গোষ্ঠীগুলো এই ধারার সমালোচনা করে বলছে, এটি কার্যত বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসীদের বৈধতা দিয়েছে।
৩১ মে মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা জানান, আসাম সরকার রাজ্যের ফরেইনার্স ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক ‘বিদেশি’ ঘোষণা করা ব্যক্তিদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাচ্ছে।
আসামের ফরেইনার্স ট্রাইব্যুনাল বিচারিক ক্ষমতা সম্পন্ন হলেও এর নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। কেননা শুধুমাত্র বানান ভুল, কাগজপত্রের ঘাটতি বা স্মৃতিভ্রষ্টতার কারণেই ট্রাইবুনাল অসংখ্য লোককে অভারতীয় বা ‘বিদেশি’ ঘোষণা করে।
গত সোমবার মুখ্যমন্ত্রী জানান, এখন পর্যন্ত ৩০৩ জন অভারতীয় অসমিয়া বা ‘বিদেশি’কে আসাম থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ১৯৫০ সালের অভিবাসী (আসাম থেকে বহিষ্কার) আইন অনুযায়ী এই প্রক্রিয়া চলমান থাকবে।
২৩ মে থেকে আসামে অভারতীয় বা বিদেশি ঘোষিতদের আটক করার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক পরিবার জানিয়েছে, তারা জানেই না তাদের আত্মীয়রা কোথায় আছে। কেউ কেউ ভিডিও দেখে তাদের আত্মীয়দের বাংলাদেশে খুঁজে পেয়েছেন এবং দাবি করেছেন, তাদের জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী এই প্রসঙ্গে বলেন, ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি কোর্ট নির্দেশনা জারি করে যে, আসাম ডিটেনশন সেন্টারে আটক বিদেশিদের অবিলম্বে তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে হবে।
রাজ্যের বিরোধী দলীয় নেতা দেবব্রত এই ‘পুশব্যাক’ প্রক্রিয়া নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি অভিযোগ করেন, বিশেষত রাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে অনৈতিক ও অমানবিক পুশব্যাক কার্যক্রম পরিচালনা করছে সরকার, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।