আজ তুরস্কের ইসলামী বিপ্লবের মহানায়ক উস্তাদ নাজমুদ্দিন এরবাকানের ১১ তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১১ সালে আজকের এই দিনে (২৭ ফেব্রুয়ারি) ৮৪ বছর বয়সে এই মহান নেতা ইন্তেকাল করেন।
তুরস্ক- যা একসময় খেলাফতে উসমানিয়ার রাজধানী বা দারুল খেলাফা ছিল। কিন্তু ইসলামের দুশমনদের ষড়যন্ত্রে শত বছর আগে বিলুপ্ত হয় খেলাফত ব্যবস্থা। মুসলিম সালতানাতের রাজধানী তুরস্ক থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয় ইসলামী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। নারীদের হিজাব পরার অধিকার থেকে শুরু করে আরবিতে আজান দেওয়াও নিষিদ্ধ ছিলো দীর্ঘ সময়।
তবে এখন আর আগের পরিস্থিতি নেই। সময় বদলছে। পরিবর্তন এসেছে। এরদোগানের নেতৃত্বে পুনরায় মসজিদে রূপ নিয়েছে আয়াসোফিয়া। কিন্তু এই পরিবর্তন সহজ ছিল না; যুগের পর যুগ বহু সংগ্রামের পর তুরস্ক তার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করেছে। এই পরিবর্তনের অন্যতম রূপকার ছিলেন নাজমুদ্দিন এরবাকান, যিনি তুরস্কের ইসলামী পুনর্জাগরণের পথপ্রদর্শক।
১৯২৬ সালের ২৯ অক্টোবর, তুরস্কের সিনোপ শহরে জন্মগ্রহণ করেন নাজমুদ্দিন এরবাকান। তাঁর শৈশব ছিল এমন একটি সময়ে, যখন তুরস্কে ইসলামবিরোধী শাসন ও ইসলামী মূল্যবোধের ওপর আঘাত চলছিল।
কিন্তু এরবাকান কখনও তাঁর বিশ্বাস থেকে সরে যাননি। তিনি সেই শাসনকালেও ইসলামী আদর্শকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন।
শিক্ষা জীবন:
এরবাকান ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র। ১৯৪৮ সালে, তিনি ইস্তাম্বুল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেন। পরে, জার্মানির Aachen Technical University থেকে যন্ত্র প্রকৌশল বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তবে, তিনি জানতেন—প্রকৌশলী হয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব, কিন্তু দেশের বৃহত্তর কল্যাণে কাজ করতে হলে রাজনীতিতেও পা রাখতে হবে।
প্রকৌশলী থেকে রাজনীতিবিদ:
১৯৫৫ সালে, সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে, তিনি গুমুশ মোটর নামক একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
এটি ছিল তুরস্কে প্রথম দেশীয় ইঞ্জিন কোম্পানি। তবে, তার এই উদ্যোগ তাকে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের শিকার বানায়।
বিশ্বের শক্তিশালী গোষ্ঠী এবং ইহুদি লবি এই উদ্যোগে বাধা দিতে শুরু করে। এই অবস্থায়, তিনি “টি ইউনিয়ন অফ চেম্বার্স এন্ড কমোডিটি এক্সচেঞ্জ অফ টার্কি”-তে যোগ দেন। তবে, সেখানেও তাঁর উদ্যোগ এবং কর্মসূচি ছিল এতটাই সাহসী, যে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই, একসময় তিনি রাজনীতিতে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন।
রাজনৈতিক দল গঠন:
এরবাকান তুরস্কের কোনিয়া শহর থেকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হন। তারপর তিনি ইসলাম ও বিজ্ঞান বিষয়ক কনফারেন্স করতে শুরু করেন। শিক্ষক ও আলেমদের পরামর্শে তিনি “মিল্লি গুরুশ” আন্দোলন ঘোষণা করেন।
এভাবেই তুরস্কে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী রাজনীতির সূচনা হয়। তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে “মিল্লি নিজাম পার্টি”, কিন্তু এক বছর পর সেটি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তবে, তিনি থেমে যাননি। গঠন করেন “মিল্লি সালামাত পার্টি”, দলটি নির্বাচনে ৪৮টি আসন লাভ করে। পরবর্তীতে তিনি সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী (অর্থনীতি বিষয়ক) হিসেবে দায়িত্ব নেন।
ক্ষমতায় তাঁর কৃতিত্ব:
এরবাকান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর তুরস্কে একটি বিপ্লব ঘটান। ৬ হাজার নিরপরাধ ইসলামীপন্থীকে মুক্তি দেন। তিনি মাদরাসা শিক্ষা উন্মুক্ত করেন, কুরআন কোর্স চালু করেন। মাদরাসার ছাত্রদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দেন। তিনি সেনানিবাসসহ সরকারি অফিসে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ইসলামি বই প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেন। তুরস্কে ধর্মীয় স্বাধীনতার ভিত্তি শক্তিশালী করেন। তাঁর অনন্য কীর্তিমালা হলো- তিনি গ্রিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তুর্কি-সাইপ্রাস রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। উম্মাহর ঐক্যের লক্ষ্যে ৮ টি মুসলিম রাষ্ট্র নিয়ে গঠন করেন ডি-এইট জোট। এছাড়া ফিলিস্তিনে মানবিক সহায়তা পাঠাতে প্রতিষ্ঠা করেন বেসরকারী সংস্থা আইএইচএইচ।
রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ও কারাবরণ:
তবে, এরবাকানের এই সাহসী পদক্ষেপগুলি কিছু শক্তিশালী গোষ্ঠীর কাছে অগ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। ১৯৮০ সালে, সামরিক ক্যু হয় এবং এরবাকানকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। তাঁকে এবং তাঁর দলকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এরবাকান কখনও থেমে যাননি।
কারামুক্তি ও প্রধানমন্ত্রী হওয়া:
১৯৮৩ সালে, তিনি কারামুক্ত হন। তারপর, গঠন করেন রেফাহ পার্টি। ১৯৮৭ সালে, তার ওপর রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে তিনি আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
১৯৯৬ সালে, জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু, সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে তার সরকার মাত্র ১১ মাস ক্ষমতায় থাকতে পারে। তবে, এই ১১ মাসে তিনি তুরস্কে শিল্পায়ন শুরু করেন। তিনি ঘোষণা করেন, “পাঁচ বছরের মধ্যে তুরস্ক জাপান ও জার্মানিকে ছাড়িয়ে যাবে।”
নতুন দল গঠন:
২০০১ সালে, তিনি সাদাত পার্টি গঠন করেন। তবে, তাঁর শিষ্য—এরদোগান ও আব্দুল্লাহ গুল— গঠন করেন একে পার্টি। তার বিরুদ্ধে বামপন্থীদের অভিযোগ ছিল, তিনি দুই দল দিয়ে দেশ চালাচ্ছেন। একটি দল শাসন করছে, আরেকটি দল সামাজিক কাজ ও ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত।
মৃত্যু:
২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান ইস্তাম্বুলে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জানাজায় ব্যাপক লোকসমাগম হয়। তার দুই ছাত্র তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল তাঁর লাশের খাটিয়া বহন করেন। এবং তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করা হয়।
উপসংহার:
নাজিমুদ্দিন এরবাকান ছিলেন এমন এক নেতা, যিনি মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। মুসলিমদের কাছে তিনি ছিলেন সংগ্রামের প্রতীক। তার আদর্শ আজও মুসলিম রাজনীতিবিদদের মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে।