Home Blog Page 4557

নেতানিয়াহু বিরোধী সংঘর্ষে আহত পুলিশ; আটক ৭ ইসরাইলি

0

ইহুদীবাদী সন্ত্রাসীদের অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে জেরুসালেমে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। তারা নেতানিয়াহুর ঘুষ ও দুর্নীতির প্রতিবাদ জানাতে এ বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে। বিক্ষোভ থেকে দুর্নীতিবাজ নেতানিয়াহুর পদত্যাগ দাবি করা হয়।

জেরুসালেমে নেতানিয়াহুর সরকারি বাসভবনের সামনে বিক্ষোভকারীরা নেতানিয়াহুর পদত্যাগ দাবিতে মিছিল করেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে কয়েকজন বিক্ষোভকারীর সংঘর্ষ হয় এবং অন্তত সাত বিক্ষোভকারীকে ইসরাইলী পুলিশ আটক করে। সংঘর্ষে একজন পুলিশ অফিসার আহত হন।

গ্রীষ্মকালের মাসগুলোতে ইহুদীবাদী সন্ত্রাসীদের অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার হয়েছে এবং করোনা ভাইরাস
এর দোহাই দিয়ে নেতানিয়াহু দুর্নীতির মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা করছেন।

শুধু তাই নয়, অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ইসরাইলের যে চুক্তি হয়েছে তারও আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে- নেতানিয়াহুর দুর্নীতির মামলা থেকে ইসরাইলি জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করা।

সূত্র: পার্সটুডে

বাগদাদে আবারও মার্কিন বহরে বোমা হামলা; দায় স্বীকার করছে না কেউ

0

ইরাকের রাজধানী বাগদাদের কাছে আমেরিকার সামরিক বাহিনীর বহরে আবারো বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। ইরাকের নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছে, রাজধানী বাগদাদের পশ্চিমে আল-গাজালি এলাকা দিয়ে বহরটি যাওয়ার সময় বোমা হামলা করা হয়।

ইরাকের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা এ হামলার কথা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, মার্কিন সামরিক বহরে হামলা চালানোর জন্য রাস্তার পাশে বোমা পেতে রাখা হয়েছিল।

ইরাকের এ কর্মকর্তা জানান, এ বহরে বেশ কয়েকটি ট্রাক ছিল যাতে সামরিক সরঞ্জাম বহন করা হচ্ছিল। তবে ওই হামলায় মার্কিন সেনাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কিনা তা পরিষ্কার নয়। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হামলার দায়িত্ব স্বীকার করে নি।

এর একদিন আগে বাগদাদের দক্ষিণাঞ্চল আরেকটি মার্কিন সামরিক বহরের ওপর বোমা হামলা করা হয়েছে। এতে একটি ট্রাকের ড্রাইভার নিহত হন।

ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে বাগদাদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের মধ্যে যখন সম্পর্কের মারাত্মক টানাপড়েন চলছে তখন মার্কিন সামরিক বহর একের পর এক বোমা হামলার কবলে পড়ছে।

সূত্র: পার্সটুডে

ঐক্য আন্দোলন নেতা সাখাওয়াতের ইন্তেকালে খেলাফত আন্দোলনের শোক

0

ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ইসলামিক নিউজ অনলাইন পোর্টালের সম্পাদক এস এম সাখাওয়াত হোসাইনের ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমীর আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, মহাসচিব মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিয়াজী, নায়েবে আমীর মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতী সুলতান মহিউদ্দিন ও প্রচার সম্পাদক মাওলানা সাইফুল ইসলাম সুনামগঞ্জী।

রোববার (২৩ আগস্ট) সংবাদমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে তারা এ শোক প্রকাশ করেন।

শোকবার্তায় নেতৃবৃন্দ বলেন, মরহুম সাখাওয়াত হোসাইন ছিলেন সৎসাহসী, নির্লোভ, নির্ভীক ও বিচক্ষন রাজনীতিবিদ। ইসলামি মিডিয়া এবং ইসলামি রাজনীতির অঙ্গনে তার ভুমিকা ছিল প্রশংসনীয়। আন্দোলনে-সংগ্রামে সবার আগে রাজপথে থাকেন এস এম সাখাওয়াত হোসাইন। কাওমী সনদের স্বীকৃতি ও সতন্ত্র আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অগ্রণী ভুমিকা পালন করে গেছেন তিনি। বহু প্রতিভার অধিকারী হাস্যোজ্জল সাখাওয়াত ছিলেন সুন্দর-মার্জিত ব্যবহারের এক বিরল দৃষ্টান্ত। ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠায় তার অপরিসীম ত্যাগ ও কুরবানী জাতির কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার ইন্তেকালে জাতি একজন স্বচ্চ ইসলামী রাজনীতিবিদকে হারালো। আমরা মহান আল্লাহ তা‘আলার দরবারে মরহুমের রূহের মাগফেরাত ও জান্নাতুল ফেরদাউসের উচ্চ মাকাম কামনা এবং তাঁর এতীম সন্তানদ্বয়সহ শোকাহত পরিবারের সকলের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনতিবিলম্বে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিন: ইশা ছাত্র আন্দোলন

0

ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি এম. হাছিবুল ইসলাম বলেছেন, করোনা সৃষ্ট বিপর্যয়ে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর শিক্ষাব্যবস্থা আজ ভেঙ্গে পড়েছে। সেদিকে লক্ষ রেখে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ করে রাখার কোন সুযোগ নেই। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনতিবিলম্বে খুলে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

রবিবার (২৩ আগস্ট) সকাল ১০টায় ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন-এর ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীর পুরানা পল্টনস্থ আইএবি মিলনায়তনে আয়োজিত সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।

এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম।

এছাড়াও বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বক্তব্য রাখেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, দলের রাজনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, যুগ্ম মহাসচিব অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, সহকারী মহাসচিব মুহাম্মাদ আমিনুল ইসলাম, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কে এম আতিকুর রহমান, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আহমাদ আব্দুল কাইয়ূম, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক মাওলানা নেছার উদ্দিন, ইশা ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি বরকত উল্লাহ লতিফ।

ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের সেক্রেটারি জেনারেল নূরুল করীম আকরাম-এর সঞ্চালনায় আরো বক্তব্য রাখেন, কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মুহাম্মাদ আব্দুল জলিল, জয়েন্ট সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুজ্জাহের আরেফী, সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ মুহা. আল আমীন, প্রশিক্ষণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম রিয়াদ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ইউসুফ আহমাদ মানসুর, প্রচার ও আন্তর্জাতিক সম্পাদক কে এম শরীয়াতুল্লাহ,

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পাদক এম এম শোয়াইব, অফিস ও যোগাযোগ সম্পাদক গাজী মুহাম্মাদ ওসমান গণী, প্রকাশনা সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ, অর্থ ও কল্যাণ সম্পাদক মুহাম্মাদ ইবরাহীম হুসাইন, কওমি মাদরাসা সম্পাদক নূরুল বশর আজিজী, স্কুল সম্পাদক মাহমুদুল হাসান, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সম্পাদক মশিউর রহমান, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাক মুহাম্মাদ সিরাজুল ইসলাম, সদস্য সোলাইমান দেওয়ান সাকিব, জামালুদ্দিন মুহাম্মাদ খালিদ, মুনতাছির আহমাদ সহ কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার সদস্যবৃন্দ ও ঢাকা নগর নেতৃবৃন্দ।

বিমান ঘাটি উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি পাওয়ার পর দিশেহারা মোদি সরকার

0

ভারতের বিমান বাহিনীর জন্য ফ্রান্সের থেকে আমদানি করা ডেসল্ট রাফায়েল বিমানের ঘাঁটি উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে।

শুক্রবার (২১ আগস্ট) অজ্ঞাতনামা সূত্র থেকে আসা চিঠিতে এ হামলার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে এবিপি আনন্দ’র খবরে বলা হয়েছে।

ভারতীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, হরিয়ানার অম্বালায় ফ্রান্স থেকে আনা পাঁচটি রাফায়েল জঙ্গি বিমান ওই ঘাঁটিতে রাখা হয়েছে। শুক্রবার অজ্ঞাতনামা একটি সূত্র থেকে আসা এক চিঠিতে ওই বিমান ঘাঁটি উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে।

দেশটির স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনায় ইতিমধ্যেই থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিরাপত্তায় কোনো ধরণের ত্রুটি রাখা হচ্ছে না। অবলম্বন করা হচ্ছে বিশেষ সতর্কতা।

উল্লেখ্য, দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর গত ২৯ জুলাই ফ্রান্স থেকে পাঁচটি রাফায়েল জঙ্গি বিমান নিয়ে আসে ভারতীয় বিমান বাহিনী। ফ্রান্সের সাথে এক চুক্তি অনুযায়ী ভারত ফ্রান্সের সামরিক বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ডেসল্ট থেকে ২৮টি এক আসন বিশিষ্ট রাফায়েল ও ৮টি দুই আসন বিশিষ্ট রাফায়েল ক্রয় করবে। যার প্রথম পাঁচটি গত ২৯ জুলাই গ্রহণ করে ভারতীয় বিমান বাহিনী।

মেজর সিনহাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে : ডাঃ ইরান

0

কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহতের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডাঃ মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেছেন, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করতে হবে। সিনহা হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। সিনহা হত্যায় জড়িত এসপি রফিককে গ্রেফতার না করে ওসি প্রদীপ ও এসআই লিয়াকতকে রক্ষার অপচেষ্টা চলছে।

মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) দুপুরে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে বাংলাদেশ ছাত্র মিশন আয়োজিত অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমেদের স্মরণসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন তিনি।

ইরান আরও বলেন, বিচারহীনতার কারণে দেশে অপরাধ জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। কোনো বাহিনী বা প্রশাসনের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকার ভারতীয় তাবেদারী ও লুটপাটে ব্যস্ত। তাই গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ছাত্রসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। এমাজউদ্দীন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রদের সন্তানদের মতো ভালবাসতেন। তিনি একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। তিনি আলোকিত জীবন ও কর্মের মাধ্যমে হাজার বছর বেচেঁ থাকবেন। বর্তমান জাতির ক্রান্তিকালে এমাজউদ্দিন স্যারের শুন্যতা আমরা বার বার অনুভব করছি।

কওমি মাদরাসা : দার্শনিক ভিত্তি ও অবদান

0

মুসা আল হাফিজ | আলেম, কবি, গবেষক


কওমি বললেই কওমি হওয়া যায় না
শিরোনামে কওমি মাদরাসা কথাটি না আনলেও পারতাম। আনলাম, কারণ, ‘কওমি মাদরাসা’ শব্দজোড়া মূলত ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার মেজাজ ও প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব করছে। ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা বলার সাথে সাথেই এর উৎস চিহ্নিত হয়। এর উৎস তো ওহির আলোকধারা আর এর গতিমুখ যদিও বৃহত্তর অর্থে সমস্ত মানবতার দিকে, কিন্তু বিশেষ ও প্রকৃত অর্থে কওম ও মিল্লাতের দিকে। সেখানেই এর লালন ও চর্চা, সেখানেই এর বিকাশ। অপরদিকে কওমি মাদরাসা বললে এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা বুঝায় যা ইসলামের আলোকে পরিচালিত, ইসলামের জন্য পরিচালিত এবং ইসলামের মাধ্যমে গুরুত্ব অর্জনকারী ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হবে। কওম একে সহযোগিতা করবে ইসলামের জন্যে, এটি বেঁচে থাকবে ইসলামের জীবনীশক্তি নিয়ে।

প্রথাগত অর্থে দারুল উলুম দেওবন্দের ভাবধারা ও শিক্ষারীতির অনুবর্তী যে সব প্রতিষ্ঠানকে আমরা কওমি মাদরাসা বলে জানি, আমাদের আলোচনা সেই জানা পথে এগুচ্ছে না। মাদরাসা বরাবরই মুসলিমদের কওমি বা জাতিয় শিক্ষাগার ছিলো। যে দর্শন, চরিত্র ও অবদান নিয়ে সে কওমি বা জাতীয় থাকে ও হয়, আমরা সেই দর্শন ও চরিত্রকে, ঐতিহ্য ও অবদানকে দৃষ্টির কেন্দ্রে রাখবো।
কওম শব্দটাকে তার ক্যানভাসে দেখলে যে বিশালতা লক্ষ করা যায় তা বিশেষ কোনো শিক্ষাধারার প্রতিনিধিত্ব করছে না; বরং জাতিসত্তার আত্মপরিচয় ও জীবনীশক্তির এক স্মারক যেন শব্দটি। কোনো প্রতিষ্ঠান নামের শুরুতে কওমি বা জাতীয় কথাটি যুক্ত করলেই সে কওমি হয়ে যায় না। এ শব্দের মর্মমূলে আছে ব্যাপক চেতনাবোধ, যার তাৎপর্য ও প্রভাব সুগভীর। যা একটি মৃতপ্রায় জাতির অসাড় অস্থিত্বে প্রাণের বিদ্যুৎপ্রবাহ জাগানোর সামর্থ রাখে। কওমি মাদরাসা যখন বলি, তখন এমন এক শিক্ষাধারার চিত্র ভেসে ওঠে, যা মুসলিম জাতির জীবন-সমস্যার ইসলামভিত্তিক সমাধানে সক্রিয়তার পথ ধরে বিশ্ব সভ্যতায় ওহিনির্দেশিত সত্য ও সভ্যতার বিকাশ দানে সচেষ্ট। এই সচেষ্টতাকে ধারণ করতে পারে না ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ কিংবা স্বৈরতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পিত কোনো প্রণালী, কোনো কর্তৃপক্ষ। কওমি মাদরাসার সারসত্য তারা লালন করে না। এটা লালনের কামনা যেমন তাদের নেই, তেমনি কামনা থাকলেও মতাদর্শগত বৈপরিত্বের কারণে এটা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

তবে কি শাসকশ্রেণী থেকে বিযুক্ত থাকবে কওমিধারা? মোটেও নয়। সে শাসকশ্রেণীকে ইসলামের জীবনবাদিতার অনুবর্তী বানাতে সচেষ্ট থাকবে। নিজেকে তাদের প্রকল্প ও ইচ্ছার আনুকূল্যে নেবে না। সে তাদের সাথে রাখবে ভারসাম্যপূর্ণ ও সম্মানজনক সম্পর্ক। কিন্তু তা কেবল আদর্শের নির্দেশে, বস্তুগত প্রাপ্তির নির্দেশে নয়। সে তাদেরকে আপন আদর্শিক সামর্থ্য ও প্রজ্ঞা দিয়ে ওহিভিত্তিক জীবনালোকের নাগরিক বানাতে চাইবে। নিজেকে তাদের ইচ্ছেপূরণের কাঁচামাল এবং পার্থিবতার অনুচর বানাবে না। এ পথে সে যদি এক পা এগোয়, মুসলিম জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্বের জায়গা থেকে ১০ পা পিছিয়ে পড়বে। কওমি বা জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজের কার্যকরিতাকে সে তখন হারাবেই।
ওহিবিসর্জিত মতবাদের ধারক যে শাসকশ্রেণী, তারা মূলত বস্তবাদী জীবন দর্শনের অনুগামী এবং ভোগবাদী মানসিকতার নির্দেশনা মেনেই সমাজ ও রাষ্ট্রকে পরিচালনা করতে চায়। মানবতার জীবন-সমস্যার ওহিভিত্তিক সমাধানের তাৎপর্য অনুধাবন ও এর অনুসৃতির ব্যাপারে তাদের চেতনা হয় পক্ষাঘাতগ্রস্ত। আর মুসলিম জীবনে জাতীয় চেতনার যে শিক্ষাধারা, তা মূলত মুসলিম জাতিসত্তার জ্ঞানভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব করতে চায়, জীবনসমস্যার ওহিভিত্তিক সমাধান ব্যক্ত ও বিশ্লেষণ করতে চায় এবং এর অনুসরণের পরিবেশ নিশ্চিত করতে চায়। ফলত শাসনব্যবস্থা যতদিন ওহিনির্দেশিত না হবে, ততদিন কওমি বলে পরিচিত শিক্ষাধারার বাগডোর সরকারের হতে যাবার কোনো আদর্শিক যুক্তি নেই। ওহির নির্দেশনা-পরিপন্থী কোনো কর্তৃপক্ষ যদি এর বাগডোর হাতে নিতে চায়, তাহলে সে ডুববে। আর মাদরাসা যদি তা তুলে দিতে চায়, তাহলে এ ব্যবস্থাটি ডুববে। সে কেবল হয়ে উঠবে একটি স্মৃতি, একটি প্রাণহীন প্রথা ও পদ্ধতি।

স্বাতন্ত্রের মাটি, দাঁড়াবার জায়গা
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা বস্তুবাদী জাহেলিয়াতের মুঠোয় ঢুকে গেলে এ শিক্ষাধারার প্রাণস্পন্দন যে থেমে যাবে, এ নিয়ে বিভ্রান্তির শিকার ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ আশা করি সন্দেহ করবেন না। মতবাদ হিসেবে নাস্তিক্যবাদ, বস্তুবাদ, ভোগবাদের সাথে এ ধারার লড়াই অবশ্যম্ভাবী। অতএব দেশে দেশে এ সব মতবাদের প্রতিভূ হিসেবে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী চাইবে এ শিক্ষাধারাকে ‘নাই’ করে দিতে। যদি দেখা যায় এটা তারা চাচ্ছে না, তাহলে বুঝতে হবে এ শিক্ষাধারা তার দায়িত্ব পালনে ত্রুটি করছে। কিংবা জাহেলিয়াতের প্রতিভূরা তাদের প্রতিপক্ষ সম্পর্কে কর্তব্যকে ভুলে গেছে। কিন্তু আমরা দেখছি এর কোনোটাই হয়নি। কওমি মাদরাসা আক্রান্ত হয়েছে এবং জাহেলিয়াত এর স্বকীয় অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কওমি মাদরাসা বস্তুবাদশাসিত এই পৃথিবীতে বিকল্প সত্যের প্রতিনিধিত্ব করেছে।

অতএব মুসলিম সভ্যতায় কওমি মাদরাসা বিশেষ এক তাৎপর্যের ভূগোল রচনা করলো, স্বাতন্ত্রের এক মিনার হিসেবে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ালো। এই স্বাতন্ত্রের কারণ এও যে, মুসলিম জাতিসত্তার নিজস্বতা ও প্রাণশক্তি লালন করার দায়িত্ব পালনে সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর এ দায়িত্ববোধের স্বারক হিসেবে এ শিক্ষাধারা স্বীয় নামের সাথে ‘কওমি’ শব্দটাকে অবিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে। সে এর লালন ও বিকাশে প্রয়াসী এবং মুসলিম জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের সবগুলো পালককে যে-কোনো মূল্যে অবিকৃতভাবে অক্ষুণ্ন রাখতে আপোষহীন থেকেছে। তার শিক্ষা এই আপোষহীনতার শর্ত তৈরি করবে। তার দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রবাহিত হবে গোটা জাতিগোষ্ঠীর নিঃশ্বাস ও বিশ্বাসের স্রোতধারা। একটি শিক্ষাব্যবস্থা এমনতর দায়িত্ব পালন করতে পারে, ঔপনিবেশিক পৃথিবীতে কওমি মাদরাসার নবোদয় না হলে এমনটি ভাবাই যেত না।

গোটা পৃথিবীতেই বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা মূলত বস্তুবাদী মানস গঠন ও ভোগবাদী জীবনপন্থার পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এগুলো প্রণীত হয়েছে এমন সব জাতিগোষ্ঠীর হাতে, যারা গোটা পৃথিবীকে নিজেদের শিকারক্ষেত্র মনে করে। ঔপনিবেশিক মস্তিস্ক-শাসনের প্রকল্প থেকে শিক্ষার যে ডিসকোর্স তৈরি হয়, সে আজও তৃতীয় বিশ্বের শিক্ষাজগতকে আপন উপনিবেশ বানিয়ে রেখেছে। এ শিক্ষাধারার বুনিয়াদ তৈরি হয় এমন এক সময়ে, যখন প্রত্যক্ষভাবে তারা গোটা বিশ্বকে পদানত করে রেখেছে এবং অধিকাংশ মানুষকে দাসানুদাস ভেবে নিজেদের প্রজা বানিয়ে রেখেছে। তারা মানুষের জীবন ও চাহিদা এবং অন্যান্য জন্তুর জীবন ও চাহিদায় পার্থক্য কী, তা জানত না।

মানুষকে বুদ্ধিমান এক জন্তু হিসেবে চিন্তা করে এদেরকে যে ধারায় শিক্ষা দিলে নিজেদের শাসন-শোষণ নিরাপদ থাকে, সেই ধারারই শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। নিজেদের জন্য রেখেছে এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা, যাতে বুদ্ধিমান জন্তু হিসেবে তারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে। অন্য সবাইকে অধীন করে রাখার সব ধরনের কৌশল আয়ত্ব করতে পারে। প্রথম ও তৃতীয় বিশ্বে এ শিক্ষাধারাই নানাভাবে পরিমার্জিত হয়ে আজও অব্যাহত। কিন্তু তা যেমন মানুষের মানবিক সত্তার কোনো প্রতিনিধিত্ব করছে না, তেমনি জাতিগোষ্ঠী সমূহের জীবনীশক্তিকেও ধারণ করতে পারছে না। কওমি বলে পরিচিত শিক্ষাধারা এর প্রতিকূলে মানুষের মানবিক সত্তাকে বিকশিত করা এবং মুসলিম মিল্লাতের মুসলিম হিসেবে যে প্রাণস্পন্দন কাম্য, তাকে শিক্ষাব্যবস্থায় ধ্বনিত করতে চেয়েছে। এই কাজটা করতে পারা না-পারার ওপর বিশ্ব সভ্যতায় নিজের সত্যিকার ভূমিকা নির্ভরশীল বলে বিশ্বাস করে আসছে। কওমি মাদরাসা বিশ্বসভ্যতায় যতটা শিক্ষাধারার মাধ্যমে, তার চেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে চেয়েছে কর্মধারার মাধ্যমে। এই চাওয়াটা নিছক আক্ষরিক চাওয়া নয়, বরং এটা এক মৌলিক দায়িত্ব, যা তাকে আঞ্জাম দিতেই হবে। দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে পারলেই সে কওম ও মিল্লাতের প্রতিনিধিত্ব করলো, নতুবা দাবি সম্বলিত ‘কওমি’ নামটির কোনো গুরুত্ব থাকে না। দাঁড়াবার জায়গা বিধ্বস্ত হয়ে যায়।

জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্ব : অনিবার্য উত্তরাধিকার
এটা তো স্পষ্ট যে ইসলামের ইতিহাসে সৃষ্টিশীল গোটা সময়ে ইসলামি জীবনবাদের ঐতিহ্যবাহী চরিত্রে শিক্ষাধারা ছিলো জারিত। ঔপনিবেশিক সময়ের আগে শতাব্দীর পর শতাব্দী এই শিক্ষাধারা কওম ও মিল্লাতের জীবনবোধ নির্মাণ ও কর্মধারার শুদ্ধির দায়িত্ব পালন করেছে। প্রতিনিধিত্ব করেছে জাতিসত্তার। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক সূচিত এ শিক্ষাধারার সম্পর্ক একদিকে আল্লাহর সাথে, অপরদিকে মানুষ ও মিল্লাতের সাথে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং এর গণচরিত্র নিশ্চিত করেছেন। যা বিশেষ কোনো গণ্ডিতে আবদ্ধ না থেকে মানুষ ও মিল্লাতের জীবনযাত্রায় অগ্রসরমানতার দিশানির্দেশ করতে চায়। ওহিভিত্তিক জীবনপ্রণালীকে দিতে চায় ইতিবাচক , সর্বজনীন ও জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠা। অনুসারীদের জন্য এ শিক্ষাধারার সাথে সম্পৃক্ততাকে তিনি বাধ্যবাধকতার বিষয় হিসেবে দেখিয়েছেন। এর সাথে ন্যূনতম প্রাথমিক সংযোগ ছাড়া গতিশীল মুসলিম জীবন অকল্পনীয়। প্রত্যেক মুসলমানকে অবশ্যই ইসলামি শিক্ষার সাথে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত হতে হবে। নতুবা ইসলামের সাথে তার সম্পর্ক দুর্বল হতে থাকবে এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়।

ফলত অনিবার্য দায় হিসেবে এ শিক্ষাধারা কওম ও মিল্লাতের দীন ও দুনিয়াকে রাঙাবার কাজ করেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। কিন্তু কওমি শব্দটি নিজের নামের সাথে যুক্ত করেনি। যুক্ত করলো তখন, যখন ঐতিহাসিক প্রয়োজন সামনে এলো। ভারত উপমহাদেশে দখলদারদের চাপিয়ে দেয়া শিক্ষাব্যবস্থা চালু হলো। তার বিকল্পে নিজের স্বাতন্ত্রের প্রচার, মানুষের স্বাধীনতা হরণকারী শক্তির প্রতিপক্ষে অবস্থানের প্রত্যয় এবং গণসম্পৃক্ততা ও জাতিসত্তার প্রতি স্বীয় অঙ্গীকারের প্রতীক হিসেবে কওমি নামটাকে ব্যানার হিসেবে সামনে আনা হলো। এ সময় গণসম্পৃক্ততা, গণসহযোগিতা ও গণস্তরে এর অধিষ্ঠানের বিষয়টি নতুন করে স্পষ্ট হলেও এর আগে গণসাহায্যের ব্যাপারটি ছিলো নাÑএমন নয়। এ শিক্ষাধারা বরাবরই প্রভুত্ব ও কর্তৃত্বকামী রাজশক্তির ছায়াকে কেবল এড়িয়ে নয়, বরং অবজ্ঞা করে সামনে এগিয়েছে। খারাপ শাসকদের দৌরাত্ম থেকে একে মুক্ত রাখতে ইসলামি ব্যক্তিত্বরা জীবনের সবকিছু দিয়ে একে আগলে রেখেছেন। জনগণকে সঙ্গী করে এর অনন্য বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্বসমূহকে পাহারা দিয়েছেন।

যতদিন খিলাফাহ আলা মিন হাজিন নবুওয়াহ প্রতিষ্ঠিত ছিলো, ততদিন এর প্রয়োজন পড়েনি। কেননা, সে সময় খলিফাতুল মুসলিমিন মুসলিমদের শিক্ষাব্যবস্থার তত্ত্বাবধান করেছেন। এ ছাড়া অবশিষ্ট সময়কালে মাদরাসাশিক্ষার দায়ভার স্কন্ধে বহন করেছেন ওলামায়ে কেরাম এবং কওম ও মিল্লাত। মুসলিম সভ্যতার সমৃদ্ধির সময়ে মাদরাসার বিস্তৃতি ছিলো অবাক করার মতো। শাসক কিংবা সরকারি কর্তাব্যক্তিরা এ সব মাদরাসায় সহযোগিতাকে গৌরব মনে করতেন।

এ কথা অবান্তর যে, শাসকরা অস্যংখ্য মাদরাসা তৈরি করেছেন, পরিচালনা করেছেন, যা তার কওমিয়্যতকে ব্যাহত করে। কারণ শাসকরা মাদরাসা বানাতে পারতেন, অনুদান দিতে পারতেন, কিন্তু মাদরাসাগুলো স্বাধীন নীতিতেই পরিচালিত হতো। যখন দেখা যেত এ নীতিমালার উপরে শাসকশক্তির হস্তক্ষেপ চলছে, তখন মাদরাসাকে হয়তো পৃথক করা হতো, অথবা মাদরাসা থেকে পৃথক হওয়ার চিন্তা করতেন উলামা। ইসলামের ইতিহাসে এমন বহুসংখ্যক সম্রাটের নাম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যাঁরা মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি শহরে বড় বড় মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এক সালাহউদ্দীন আইয়ুবি রহমতুল্লাহি আলায়হি মিসর, দামেশক, মেসেল, বায়তুল মুকাদ্দাসের প্রত্যন্ত এলাকায় অসংখ্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। সিরিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন ১৪টি বড় বড় জামেয়া, বিশ্ববিদ্যালয়। দামেশকে ছয়টি, হলবে চারটি, মহাতে দু’টি, হেমসে একটি, বা’লাবাক্কে একটি জামেয়া তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। (সেগুলো ছিলো সত্যিকার জামেয়া। এখন তো মক্তবের নামের আগেও জামেয়া লাগানো হচ্ছে। সত্যিকার জামেয়া ছিলো বলেই গোটা দামেশকের প্রয়োজন পূরণে ছয়টি প্রতিষ্ঠানই যথেষ্ট ছিল। এর আগে দামেশকে আরও চারটি জামেয়া ছিলো। ১০টি জামেয়া গোটা দামেশকে জ্ঞানের বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল। এখন শতটি দিয়েও কাজের কাজ হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না, তা অন্য কোথাও, অন্য কোনো দিন আলোচনার ইচ্ছা রইলো।)

সাধারণ মাদরাসা দামেশকে ছিলো বিপুল সংখ্যক। আবাসিক সুবিধা সম্বলিত মাদরাসাই ছিলো চারশো’র অধিক। দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্ররা এসে এমন মাদরাসায় শিক্ষা গ্রহণ করত। কোনো পর্যটক যদি দামেশকে এক বছর অবস্থানের জন্য আসতেন, প্রত্যেক মাদরাসায় এক রাতের বেশি অবস্থানের সুযোগ তাঁর হতো না। কারণ দামেশকে মাদরাসার সংখ্যা ছিলো অনেক বেশি। প্রতি মাদরাসায় এক রাত করে অবস্থান করে বছর শেষ হয়ে যেত। মাদরাসার এই বিপুলতা অবদানের ক্ষেত্রে কী ব্যাপকতার দাবি রাখে, তা বোঝাবার জন্যে মাত্র একটি শহর থেকে মাদরাসাগুলোর সংখ্যাগত অনুমান পেশ করলাম।

এই সব মাদরাসা জনগণের সাহায্যে চলত। সেলজুক উজিরে আজম নিজামুল মুলক তুসি ইরাক ও খোরাসানের প্রতিটি শহরে একটি করে উচ্চতর মাদরাসা স্থাপন করলেও সেগুলোর উপর তাঁর কোনো আধিপত্য ছিলো না। প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীন নীতিতেই চলত। জনগণের মধ্যে মাদরাসার জন্য জমি ওয়াকফ করার প্রতিযোগিতা চলত। ওয়াকফ সম্পত্তির কারণে মাদরাসাগুলোর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা মজবুত থাকত। কিন্তু জনগণ নিজের জায়গা-জমি এমনকি বাসভবনও মাদরাসাকে দান করে ধন্য হতেন। দামেশকে ওয়াকফের প্রাচুর্য এতোই ছিলো যে, ইমাম নববি রহ. সারা জীবন দামেশকে উৎপন্ন কোনো ফল খাননি। কারণ, দামেশকের অধিকাংশ এলাকাই ছিলো ওয়াকফ করা। অত্যাচারী লোকেরা সে সব আত্মসাৎ করেছিলো ।

তখন এ শিক্ষাধারা জনগণের জীবনযাত্রার সাথে অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছিলো। কারণ সমাজ ছিলো জ্ঞানভিত্তিক। উলামার জায়গা ছিলো বৃহত্তর জীবনে প্রতিনিত্বের জায়গা এবং জীবন ও জগতের প্রয়োজনীয় প্রতিটি জ্ঞানকে তখন তাঁরা লালন করতেন এবং পরিচর্যা করতেন। এর চর্চা, প্রসার ও নিত্য-নতুন গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন উলামার কোনো না কোনো শ্রেণী। মানুষের জ্ঞানজগতের সবধরনের চাহিদাপূরণে সব ময়দানেই ছিলেন বিশেষজ্ঞরা। প্রত্যেকের জীবনের কেন্দ্রে ছিলো দীন ও দীনি দর্শন। কিন্তু জীবনবাস্তবতার কোনো চাহিদা সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন না তাঁরা। জীবনের কোনো যাত্রীদলই তাঁদের সীমানার বাইরে ছিলো না। প্রতিটি কাফেলার পথ ও পথের উপকরণের সাথে তাঁরা ছিলেন পরিচিত।

মানুষ ও মানুষের পৃথিবী তখন তাঁদের সহযাত্রী। কওমিয়্যাত তখন বাস্তবিকভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছিলো। মাদরাসাগুলো এ অঙ্গীকার প্রচার করতো যে, তারা মানবতার ভেতরে-বাইরে যত দরিদ্রতা, তা দূর করার ব্যবস্থা দেবে। জীবন ও জগতের ক্ষতস্থানসমূহের চিকিৎসা করবে।

দার্শনিক অঙ্গীকার
অঙ্গীকারের এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং এখান থেকে আমরা আলোচনাকে সামনের দিকে নিতে পারি। আমরা দেখবো অতীতে মাদরাসা মানবতার কোন কোন দরিদ্রতাকে দূর করতে চেয়েছে এবং কোন দানে তাকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছে। এ বিষয়টাকে ভালোভাবে ধরতে পারলে মাদরাসা আজ কী করতে পারে ও কী করছে, মানবতার কোন কোন দারিদ্র্য দূরীকরণ তার কাজ, এ ক্ষেত্রে সে কী করবে এবং কীভাবে করবে, তা উদ্ঘাটন সহজ হবে। আমরা বিশ্বসভ্যতায় মাদরাসার মৌলিক অবদান চিহ্নিত করতে পারি দর্শন ও শিক্ষার কয়েকটি ক্ষেত্রে।

প্রথমত : মানুষ নিজের সাথে কীরূপ সম্পর্ক রাখবে, এ সম্পর্কে ভারসাম্যপূর্ণ ও সত্যিকার কোনো দার্শনিক সমাধান শিক্ষব্যবস্থায় ছিলো না। গ্রিক বা রোমান শিক্ষা ও দর্শন মানুষের মর্যাদাময় পরিচয় এবং তার উৎস, উদ্দেশ্য ও গন্তব্য সম্পর্কে বিভ্রান্ত ছিলো। এ বিভ্রান্তির ফলে মানুষ নিজের সাথে কীরূপ সম্পর্ক রাখবে, এটা নির্ণয়েও গুরুতর ভ্রান্তির কবলে পড়ে। ভারত, চীন বা আফ্রিকায় যে সব প্রথাগত শিক্ষার ছিটেফোঁটা ছিলো, সেখানে মানুষের সত্তাগত পরিচয় ও অস্তিত্বের মৌলিক এ ব্যাপারটির কোনো কূল-কিনারা পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো দর্শন মানুষের দেহ-সত্তাকেই দেখেছে এবং ভুল করেছে। কোনো কোনো দর্শন কেবল আত্মাকেই স্বীকার করেছে এবং হোঁচট খেয়েছে। কেউই সম্পূর্ণ ও যথাযথভাবে জীবনকে উপলব্ধিই করতে পারেনি। শিক্ষাব্যবস্থায় এর পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা মাদরাসাই দাঁড় করাতে সক্ষম হলো। মানবসভ্যতা মানুষের মর্যাদাময় পরিচয়, প্রকৃতি এবং আত্মা ও দেহের সুষম, সুসামঞ্জস্যপূর্ণ বিকাশের নিশ্চয়তা দিলো ইসলাম। ফলে মানুষের সামনে খুলে গেলো মহিমান্বিত জীবনবোধের বাস্তবিভিত্তিক রাজতোরণ।

দ্বিতীয়ত : মানুষ মানুষের সাথে কীরূপ সম্পর্ক রাখবে, এ বিষয়টা উন্নত সভ্যতা গঠনের মৌলিক এক দার্শনিক সমস্যা। এ বিষয়টিতে বিচ্যুতি হলে সমাজ ও সভ্যতায় বিপর্যয়ের দরোজা খুলে যাবে। মাদরাসাশিক্ষা পৃথিবীর কাছে ইসলামি মুয়ামালা ও মুয়াশারাতের রূপরেখায় এমন এক মানবিক সম্পর্ক-কাঠামো উপস্থাপন করলো, যার আগে এর কোনো নজির ছিলো না, পরেও কোনো উন্নত ও ইনসাফপূর্ণ বিকল্প কেউ দাঁড় করাতে পারেনি। পশ্চিমা দর্শনে যে রূপরেখা লক্ষ্যণীয়, তা বস্তুবাদ ও প্রবৃত্তিপূজার মানসিকতাকে পরিপুষ্ট করে। সেখানে মানবিক মহাত্মের কিছু পদচ্ছাপ থাকলেও তা মূলত ইসলামি রূপরেখার বিকৃত অনুকরণ। কিন্তু এ অনুকরণের প্রভাবে আধুনিক সভ্যতা যে প্রাণশক্তির অধিকারী হয়েছে, তা এক কথায় অসাধারণ। এরই ফলে জামালুদ্দিন আফগানি রহ. বলেছিলেন, ‘পশ্চিমারা মুসলমান না হলেও তাদের মুয়ামালাত ও মুয়াশারাত তথা ব্যবহারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক আচরণে কলুষতার পর্দা ছিঁড়ে ইসলামের ঝলক ফুটে উঠতে দেখেছি। বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসি ঠিকই বলেছিলেন, পশ্চিমা সভ্যতা ইসলামের দ্বারা গর্ভবতী । যা গর্ভে ধারণ করেছে, তাকে সে প্রসব করবে।’

এই গর্ভধারণের ঘটনা পৃথিবীর অন্যত্রও ঘটেছে। ইসলামি শিক্ষার সংস্রব পাওয়ার আগে ভারতবর্ষের মানুষ যেভাবে মানুষের সাথে সম্পর্ক বিষয়ে ভয়ানক বর্ণবাদ-প্রথার শিকার ছিলো, তেমনি ইউরোপ ছিলো নীতিহীনতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। আফ্রিকায় তো জঙ্গলের নিয়ম চলত। চীন ও তাতার উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় সামাজিক নিষ্ঠুর প্রথাই ছিলো মানুষে মানুষে সম্পর্কের নীতিমালা। যে সব প্রথার মূলে ছিলো ভয়াবহ বৈষম্য ও অবিচার। শিক্ষার মাধ্যমে এই অবিচারেরই স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা হতো। ইসলামি শিক্ষা সেখানে সত্যিকার সম্পর্কের রূপরেখা দাঁড় করায়। মাদরাসা হয় এর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক চর্চা ও চর্যার লাইট হাউস।

তৃতীয়ত : মানুষ বিশ্বজগতের সাথে কেমন সম্পর্ক রাখবে, এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ও সত্যিকার দার্শনিক নীতিমালা শিক্ষাধারায় প্রবর্তন করা হয়। আল্লাহর সৃষ্টিজগতকে গভীরভাবে উপলদ্ধি করে এর প্রতি প্রখর বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের নীতি গ্রহণ করে ইসলামি শিক্ষা। এ শিক্ষাধারা গোটা বিশ্বজগতকে খোদার নিদর্শন এবং সমস্ত সৃষ্টবস্তুকে মানবকল্যাণের নিমিত্তে তাঁর প্রদত্ত নেয়ামত হিসেবে দেখলো। আনফাস ও আফাক তথা প্রাণ ও প্রকৃতিতে, দিগি¦লয়ে নিহিত সত্যকে খোদা পর্যন্ত পৌঁছার একটা দরজা হিসেবে দেখলো, একে খোদা ভাবলো না। অথচ তখন গোটা বিশ্বেই সৃষ্টিজগতের বিশেষ বস্তুসমূহ মানুষের কাছে খোদারূপে পূজ্য ছিলো। ইউরোপ-আফ্রিকা ও এশিয়ার জনপদে জনপদে মানুষ চন্দ্রের, সূর্যের, উঁচু পাহাড়ের, সুবিশাল সমুদ্রের, বিশাল বৃক্ষের, কিংবা আকাশের বা ঘন অরণ্যের উপাসনায় লিপ্ত ছিলো। মানুষ ছিলো সকল কিছুর গোলাম। সর্বত্রই ছিলো তার মাবুদের ছড়াছড়ি। সে কাউকেই অধিনস্ত ভাবার সাহস পেতো না। প্রকৃতিকে অধিকার করার প্রয়াসে সে প্রস্তুত ছিলো না। প্রাণ ও প্রকৃতি নিয়ে ছিলো অগণন পাথরসম কুসংস্কার। যার উৎসে ভুল ও অজ্ঞতা। বিশাল জগত, জীব ও তার বিচিত্র ক্রিয়া-প্রক্রিয়া নিয়ে সত্যের স্বাধীনতা নিয়ে জ্ঞানচর্চা করবে, মুক্তআলোকে গবেষণা করবেÑএ উৎসাহ তার ছিলো না।

সে জানতো না বিশ্বজগতের সাথে তার সম্পর্কের প্রকৃতি কী হবে? শিক্ষাব্যবস্থায় এর কোনো বাস্তব দিক-নির্দেশনা ছিলো না। কোথাও কোথাও আবার বিশ্বজগতের সমস্ত বিষয়কে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে গুহার ভেতরে জীবন কাটানোর শিক্ষা প্রচলিত ছিলো। মধ্যযুগীয় ইউরোপে কয়েক শতাব্দী ধরে জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হবার উৎসাহ বিদ্যমান ছিলো। জীবন ও জগত থেকে লোকেরা থাকত ক্ষুব্ধ, দুনিয়ার সুখসামগ্রীকে মনে করা হতো মানবিক উন্নতির শত্রু এবং সমাধিস্থলের ভৌতিক পরিবেশে ধার্মিক লোকেরা আশ্রয় নিতো এই শত্রু থেকে আত্মরক্ষার জন্য।

ইসলামি শিক্ষাজগতের সাথে মানুষের সম্পর্কের প্রকৃতি ও এর পর্যায়সমূহকে যথার্থভাবে উদ্ঘাটন করে ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা দাঁড় করায়। যার ফলে প্রকৃতি যেভাবে মানুষের প্রভু হয় না, আবার মানুষ প্রকৃতির জন্য জালেম হয় না। বরং সে নীতিমালা না থাকলে সভ্যতার উন্নতি তো অর্জিত হতোই না, বরং মানবতার সুমহান সম্ভাবনা সমূহ আতুড়ঘরেই ধুঁকতে থাকত। মজার ব্যাপার হলো, মধ্যযুগে ইউরোপে পার্থিব জীবকে অবাঞ্চিত বলে শিক্ষা দেয়া হতো, আর আধুনিক ইউরোপ পার্থিবতাকে এমনভাবে পূজা করছে, যেভাবে পেটুক তার খাদ্যবস্তুকে গলধঃকরণ করে মাত্র। কিন্তু একে কোনো মূল্য দেয় না। ইসলামি শিক্ষা বিশ্বজগতকে প্রশান্তি ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতে শেখালো, এর প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে এর কল্যাণসমূহকে নিশ্চিত করার প্রেরণা যোগালো।

এর প্রতি উপেক্ষা বা অবমূল্যায়নের পরিবর্তে বিশ্বজগতে আল্লাহর প্রতিনিধিসূলভ ভুমিকা পালনে মানুষের জন্য পদ্ধতিগত রাজপথ উন্মুক্ত করে দিলো। মাদরাসা ও তার সন্তানরা আপন সময়ে এই রাজপথে দুনিয়ার অভিযাত্রাকে দিলেন নেতৃত্ব।

চতুর্থত : বিশ্বজগতের স্রষ্টার সাথে মানুষের সম্পর্ক কেমন হবে, এ বিষয়ে জগত ছিলো সবচেয়ে বেশি অন্ধকারে। গ্রিক সভ্যতা আল্লাহর অস্তিত্বকে এতোটাই বিকৃতভাবে জানত যে, তারা মনে করত আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক শত্রুতামূলক। এ কারণে তারা প্রমিথিউসের আগুন চুরির কাহিনি সাজিয়েছে। যেখানে মানুষ ইশ্বরের পবিত্র আগুন চুরি করে। প্রতিশোধস্বরূপ ইশ্বর মানুষের সর্বনাশের জন্য সবধরনের ক্ষতিকর জিনিসে ভর্তি প্যান্ডুরার বাক্স পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। গ্রিকরা ইশ্বরকে জানত আহমিকাময়, ক্ষতিকর কোনো সত্তা হিসেবে। যাকে যেভাবেই পারা যায় খুশি রাখতে হবে। তার প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা থেকে মানুষকে বাঁচতে হবে।
খোদা আবার বহুজন। প্রতিজনকে পৃথকভাবে খুশি রাখতে হবে। না-হয় সর্বনাশ হয়ে যাবে। যেমন পোসাইডনকে খুশি না রখলে সমুদ্র উন্মত্ত হয়ে ওঠে। দেবতাদের মধ্যে আবার লড়াই হয় এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেবতার লড়াইয়ে পৃথিবী ধ্বংস হবে।

গ্রিকদের উর্বর মস্তিস্ক খোদা সম্পর্কে যে কল্পনা সাজায়, তা থেকে তেমন ভিন্ন নয় রোমানদের বিশ্বাস। তারা অবশ্য খোদা সম্পর্কে মনে করত, তিনি থাকলে আছেন, না থাকলে নেই। প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের সময় তিনি নেই। বিশেষ বিপর্যয়ে বা প্রার্থনায় মনের একটি আশ্রয় হিসেবে তিনি আছেন। কিন্তু পরে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করায় খ্রিষ্ট্রীয় আকিদায় রোমানরা দীক্ষিত হয়ে যায়। খ্রিষ্টবাদ মানুষের সাথে সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ককে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে। নিজেদের জন্য সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহকে সাব্যস্ত করেছে, যদিও তারা পাপে গলা অবধি ডুবন্ত থাকে। আর এই সম্পর্কের ভিত্তিতে অনাচারের বাজার গরম করে তুলেছে এবং ইহুদিরা একই কাজ করেছে। একে তারা উন্নত মানবতার বিকাশের প্রাণশক্তি হিসেবে দেখার পরিবর্তে নিজেদের জাতিগত দুর্নীতির হাতিয়ার বানাতে চেয়েছে। অন্যান্য ধর্ম স্রষ্টা সম্পর্কে বিশ্বাস পোষণ করে এবং মানুষের সাথে তাঁর যে সম্পর্কের কথা শিক্ষা দেয়, তা মানুষ ও সভ্যতাকে মহিমান্বিত করে না; বরং মানুষের মর্যাদা, শক্তি ও ব্যতিক্রমী সম্ভাবনাকে এমন সব মাখলুকের পদতলে সমর্পণ করে, যারা মূলত তারই পদতলে সমর্পিত হওয়ার কথা।
সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্কের সুষ্ঠু ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা ছাড়া মানুষের আধ্যাত্মিক বিকাশ মুখ থুবড়ে পড়ে। ফলে সভ্যতা অগ্রগতির রক্তপ্রবাহ থেকে বঞ্চিত হয়। পরিচ্ছন্ন জীবনবোধ সে খুঁজে পায় না। তার অগ্রগতি পদে পদে বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে ইসলামি শিক্ষার অনুগ্রহ মানব সভ্যতার উপর অত্যন্ত বিশাল। মাদরাসা শিক্ষাধারা সৃষ্টিকর্তার সাথে মানুষের সম্পর্কের ইসলাম-নির্দেশিত রূপরেখা প্রবর্তন করেছে। যা আকিদা হিসেবে যেভাবে মহোত্তম, তেমনি মানব জীবনে আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত পরিশুদ্ধির জন্য বিকল্পহীন দিকদর্শন। এই দিকদর্শন মানুষকে প্রতিনিয়ত আরও মানুষ বানায়, সভ্যতাকে রক্ষা করে পশুত্বের ছায়া থেকে। পৃথিবীকে দান করে জীবনীশক্তির বিভা। সভ্যতাকে দান করে নিশ্বাসের সুবাতাস আর উৎকর্ষের জীবনজল।

বর্ণিত মৌলিক দার্শনিক অবদানসমূহ উন্নত সভ্যতার বুনিয়াদ গঠনে কাজ করেছে। এর উপর উপজাত শাখা-প্রশাখাগত যে সব অবদান, তার তুলনা সূর্যের আলোর সাথে, যার বিশেষ কোনো সংখ্যাগত বিচার চলে না। আধুনিক সভ্যতার উন্নতি এবং জ্ঞান ও মানবমনের সৃষ্টিশীলতার যে জাগরণ, তার বীজতলা তৈরি হয় মাদরাসারই অনুদানে। শিক্ষা, গবেষণা, বিজ্ঞান ও মানুষের আত্মশক্তির উত্থানের যে-সব মহাকাব্য রচনা করেছে আধুনিক বিশ্ব, এর অধিকাংশ উপাদান মাদরাসা থেকে গৃহীত। কিন্তু তা অস্বীকার করতে আধুনিক বিশ্ব যার পর নাই যত্নবান থেকেছে।

আয়া সোফিয়া: পশ্চিমারা যে তথ্য গোপন করছে (প্রথম পর্ব)

0

মুহাম্মাদ গোলাম রব্বানী ইসলামাবাদী | গবেষক ও রাষ্ট্রচিন্তক


ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গী সবসময়েই সন্দিগ্ধ হয়ে এসেছে। তাদের প্রচার-মাধ্যম, প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গী ইত্যাদিতে মুসলমানদের প্রতি একটা বিরূপ-দর্শন বিভিন্ন প্রকাশে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সম্প্রতি তুরস্কের আয়া সোফিয়াকে নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বের প্রতিক্রিয়া সে-কথাকেই জানান দিচ্ছে। পাঠকদের জানা থাকা দরকার, তুরস্কের বিখ্যাত মসজিদ আয়া সোফিয়া: যা কুসতুনতুনিয়া (Constantinople) বিজয়পূর্ব ‘সেন্ট সুফিয়া’ নামে খৃষ্ট সমাজের কাছে পবিত্র গীর্জা হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিলো। রোমান ক্যাথলিক এবং অর্থডক্স—উভয় শ্রেণীর জন্য সেন্ট সোফিয়া ছিলো পবিত্র একটি উপসনালয়। ইতিহাসে দেখা যায়, প্রথম রোমান সম্রাট জাসটিনিয়ানের নির্দেশে ৫৩২ ঈসায়ী সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়ে ৫৩৭ সালে শেষ হয়। ১৪৫৩ সালে ইসলামের মহান সিপাহসালার সুলতান মুহাম্মাদ ফাতেহ’ রহ.-র হাতে কুসতুনতুনিয়ার পতনের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ৮৯৮ বছরব্যাপী বর্তমানের আয়া সোফিয়া সেন্ট সুফিয়া নামে ঈসায়ী সমাজের গীর্জাঘর হিসাবে পরিচিত হয়ে আসে। ১৪৫৩ সালে কুসতুনতুনিয়া বিজয়ের পর সুলতান মুহাম্মাদ ফাতেহ তৎকালীন গীর্জার জাযকদের কাছে সেন্ট সুফিয়াকে ক্রয়ের প্রস্তাব দেন। এতে সেন্ট সুফিয়ার জাযকবৃন্দ একটি লিখিত দলিলের মাধ্যমে সুলতান ফাতেহের কাছে গীর্জাঘরটি ও জমি বিক্রয় করেন এবং সুলতান তা মসজিদের জন্য ওয়াকফ করে একটি ট্রাস্টের কাছে সমর্পণ করেন। সেই থেকে ‘সেন্ট সুফিয়া’ গীর্জাটি আয়া সুফিয়া নামে মুসলিমে বিশ্বের গৌরবোজ্জ্বল মসজিদ হিসাবে পরিচিত হয়ে এসেছে এবং তা রাষ্ট্র হিসাবে তুরস্কের জাতীয় সম্পদ হিসাবে বিবেচিত। ইতোমধ্যে এ সম্পর্কিত সুলতান মুহাম্মাদ ফাতেহের ক্রয়-সনদের (Charter) চিত্র কিছুকিছু ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। যেহেতু সুলতান ফাতেহ জমি ও স্থাপনা নিজ অর্থে ক্রয় করেছেন, তাই সেটাকে মসজিদে রূপান্তর করে নেন। এরপর থেকে উক্ত স্থাপনায় ঈসায়ী সমাজের আর কোন বৈধ অধিকার বজায় থাকেনি।

খুব সম্ভবত, ২০০৫ সালে একটি তুর্কী এনজিও এই মর্মে আদালতে আর্জি জানায়, আয়া সোফিয়া কুসতুনতুনিয়া বিজয়ী সুলতান মুহাম্মাদ ফাতেহের ব্যক্তিগত সম্পত্তি যা তিনি পরে মসজিদের জন্য ওয়াকফ করে যান। সঙ্গতকারণে তারা ১৯৩৪ সালে কামাল আতার্তুক কর্তৃক আয়া সোফিয়াকে মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপান্তরকরণকে অবৈধ ঘোষণা করে পুনরায় মসজিদ হিসাবে রূপান্তরের আদেশ প্রার্থনা করেন। আদালত পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষণোত্তর রায় প্রদান করে বলেন: আয়া সোফিয়া যেহেতু সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ ফাউন্ডেশনের সম্পত্তি, তাই ১৯৩৪ সালে জাদুঘরে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত ছিলো সম্পূর্ণ অবৈধ। সুলতানের রেখে যাওয়া সনদ-মোতাবেক এটাতে পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই ( The Council of State ruled that since the Hagia Sophia is owned by the Fatih Sultan Mehmet Han Foundation, it’s status on the deed is listed as a mosque and cannot be changed. The council reasoned Ottoman Sultan Mehmet II, who conquered Istanbul, deemed the property to be used by the public as a mosque without any fees and was not within the jurisdiction of the Parliament or a ministry council. The Council of Ministers’ decision to turn the mosque into a museum was made in 1934, in the early years of the modern secular Turkish state founded by Mustafa Kemal Ataturk. The lawyer of the group seeking to convert the iconic edifice back into a mosque argued that the building was the personal property of Ottoman Sultan Mehmet II. A state attorney, meanwhile, argued that the 1934 decision was legal. He recommended the request be rejected, arguing that a decision on restoring the structure’s Islamic heritage was up to the government, the agency said. (https://www.trtworld.com/turkey/turkish-court-rules-1934-conversion-of-hagia-sophia-into-museum-illegal-38028)।

এখন দেখা যাচ্ছে, আয়া সোফিয়াকে নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। প্রথমত, এটা মূলত ঈসায়ীদের গীর্জা এবং সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ ১৪৫৩ সালে কুসতুনতুনিয়া দখলের পর সেন্ট সুফিয়াকে বলপূর্বক মসজিদে রূপান্তরিত করেন—এমন ধারণা প্রচারিত হয়ে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে আমাদের অনেকের মধ্যেই বিভ্রান্তি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। যুক্তি উত্থাপনের খাতিরে নয়, উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ১২৩৬ সালে রাজা তৃতীয় ফার্নিনান্ডের (Ferdinand III of Castile) স্পেন বিজয়ের পর কর্ডোভার কেন্দ্রীয় মসজিদকে গীর্জাতে পরিণত করা নিয়ে কোন বিভ্রান্তি হচ্ছে না। অথচ সবাই জানেন, আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ ক্রয়-সনদের মাধ্যমে যে স্বচ্ছতা রেখে গিয়েছেন—তা কিন্তু কর্ডোভার ক্ষেত্রে পাওয়া যায়নি। উপরন্তু সম্প্রতি স্পেনের মুসলিমরা ঈসায়ীদের পাশাপাশি কর্ডোভার বর্তমান গীর্জায় নামায পড়ার অনুমতি চাইলে স্পেনের চার্চ ও ভ্যাটিকেন তা প্রত্যাখ্যান করে (Muslims across Spain have lobbied the Catholic Church to allow them to pray in the complex, with the Islamic Council of Spain lodging a formal request with the Vatican. However, Spanish church authorities and the Vatican have opposed this move.-https://en.wikipedia.org/wiki/Mosque%E2%80%93Cathedral_of_C%C3%B3rdoba )। যা হোক, আসলেই সুলতান ফাতিহ সেন্ট সুফিয়া ক্রয় করেছেন কি না, তা নিয়ে মুসলিমদের মধ্যেই অজ্ঞতাবশত সন্দেহ রয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে সন্দেহ নিরসনে কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরছি:

প্রথমত, ২০০৫ সালে দায়েরকৃত মামলার আদেশের (ruling) একটি অংশ আমি আগে উল্লেখ করেছি। আদালত সেখানে বলেছে: The Council of State ruled that since the Hagia Sophia is owned by the Fatih Sultan Mehmet Han Foundation, it’s status on the deed is listed as a mosque and cannot be changed. অর্থাৎ, কাউন্সিল অব স্টেট আদেশ প্রদান করছে যে, আয়া সোফিয়া সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ ফাউন্ডেশনের স্বত্বাধীন সম্পত্তি, সনদে এটাকে মসজিদ হিসাবে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং এটা কোনভাবেই পরিবর্তনযোগ্য নয়। তাহলে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, বাদী পক্ষ আদালতে দলীল-দস্তাবেজ দিয়ে প্রমাণ করতে পেরেছে: আয়া সোফিয়া সুলতান ফাতিহ জাযকদের কাছ থেকে ক্রয় করেছিলেন।

দ্বিতীয়ত, সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বক্তব্যসম্বলিত তুর্কী ভাষায় একটি ভিডিও ক্লিপ ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছে (How Ayasofya become property of Sultan Fatih? Tells Erdogan )। ক্লিপটির সাব-টাইটেলে এরদোগানের বক্তব্যের উর্দু অনুবাদ করা আছে। অনুবাদটি পাঠকদের উদ্দেশ্যে এখানে তুলে ধরছি:

کیو کہ آیا صوفیا نہ ریاست کی ملکیت ہے بلکہ وقف اثاثہ ہے- جب سلطان فاتح نے استنبول فتح کیا تو رومن بادشاہ کا عہدہ بھی پالیا-اور اس وجہ سے بازنطین کے نام رجسٹرڈ تمام املاک کے مالک بھی بن گیئے-تو قانون کے لحاظ سے اور اس کی بنائ گئی وقف کے نام ہو گئی- جمہوری دور میں، سرکاری طور پر یہ وراست نامہ نئے الفاظ کے ساتھ تیار کرتے ہو ئے جاری ہوا اور اس کی قانونی حیثیت کو رجسٹر کیا گیا- اگر آیا صوفیا سلطان فاتح کی وراثت نہ ہوتی تو وہ اس کو واقف کرنے کا کوئی قانونی حق نہ رکھتے ہوتے-

(বলা হচ্ছে: কেননা, আয়া সোফিয়া রাষ্ট্রের অধীন কোন সম্পত্তি নয় বরঞ্চ ওয়াকফকৃত সম্পত্তি। সুলতান ফাতিহ যখন ইস্তাম্বুল বিজয় করলেন, তৎকালীন রোমান বাদশাহর ক্ষমতাও পেয়ে গেলেন। সম্রাট বাইজেনটাইনের নামে নিবন্ধিত সব সম্পদের মালিক হয়ে গেলেন সুলতান। গণতান্ত্রিক যুগে সরকারীভাবে সুলতানের উত্তরাধিকার-সনদকে আধুনিক ভাষায় রূপান্তরিত করে জারি করা হয় এবং এর আইনগত অবস্থানকে নিবন্ধিত করা হয়। আয়া সোফিয়া যদি সুলতানের উত্তরাধিকার-স্বত্ব না হতো, তবে তিনি স্থাপনা ও জমি ওয়াকফ করার কোন আইনগত অধিকার পেতেন না।)

তৃতীয়ত, সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ কর্তৃক সেন্ট সুফিয়া ক্রয় করা ও ওয়াকফ করার বিষয়টি কিছুকিছু আন্তর্জাতিক প্রচার-মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। যেমন, বহুল পরিচিত বৃটিশ সাংবাদিক রেডলী (Yvonne Ridley) যিনি ২০০১ সালে আফগানিস্তানে তালিবানের হাতে বন্দী হন এবং ২০০৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তি পেয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন, Middle East Monitor-র ১৩ই জুলাই ২০২০ সংখ্যায় Hagia Sophia: Religious and political leaders are missing their own chances to right historical wrongs অর্থাৎ, আয়া সোফিয়া: ঐতিহাসিক ভুল সংশোধনে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতারা তাদের সুযোগ হারাচ্ছেন শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেন। সেখানে তিনি লিখেন: The decision to preserve the church-turned-mosque as a museum had no legitimacy since the Hagia Sophia building and land was protected by a Waqf established by Sultan Mehmet II back in 1453. The original deed confirming this is still in the archives in Ankara. The wealthy Ottoman leader and conqueror of Constantinople, as it was known then, bought the building from the Christian authorities of the day. (বলা হচ্ছে, ১৪৫৩ সালে দ্বিতীয় সুলতান মুহাম্মাদের ওয়াকফ দ্বারা সংরক্ষিত গীর্জা থেকে মসজিদে রূপান্তরিত করা স্থাপনাটিকে জাদুঘর হিসাবে রেখে দেয়ার সিদ্ধান্তের কোন আইনগত বৈধতা নেই। আয়া সোফিয়ার স্থানান্তরের মূল দলীল এখনও আঙ্কারায় সংরক্ষিত আছে। এটা জানা কথা যে, বিত্তশালী উসমানীয় সম্রাট যিনি কুসতুনতুনিয়া জয় করেন, তৎকালীন খৃষ্টান কর্তৃপক্ষ থেকে গীর্জাটি কিনে নিয়েছিলেন।)

চতুর্থত, মূলসূত্র উল্লেখ ছাড়াই কয়েকটি নিউজ পোর্টাল আয়া সোফিয়া সংক্রান্ত কিছু তথ্যের উল্লেখ করেছে। সূত্রের উল্লেখ না থাকলেও তথ্যগুলো আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। উদাহরণসরূপ, অনলাইন নিউজ পোর্টাল উম্মাহ২৪ ডট কম তাদের ১২ই জুলাই, ২০২০ সংখ্যায় আয়া সোফিয়াকে নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। সেখানে বলা হচ্ছে: ১৪৫৩ সালে উসমানিয়া খলিফা আবুল ফতেহ সুলতান মোহাম্মদ ইস্তাম্বুল বিজয়ের পর খ্রিস্টান ধর্মীয় নেতাদের কাছে এটি ক্রয় করে নেওয়ার প্রস্তাব দেন। তবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থে নয়, বরং নিজের ব্যক্তিগত অর্থ দ্বারা। সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদ (আবুল ফতেহ সুলতান মোহাম্মদ) শত্রু এবং ইতিহাস সম্পর্কে অত্যন্ত বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান ছিলেন। শাসক হিসেবে রাজ্যের কোষাগার কিংবা মুসলমানদের “বায়তুল মাল” থেকে কোনো অর্থের পরিবর্তে তিনি ওই ভবন ক্রয় করার প্রস্তাব দেন একান্ত ব্যক্তিগত সম্পদ দ্বারা, যা ছিল এক নজিরবিহীন পদক্ষেপ।

১৪৫৩ খ্রীস্টাব্দে হরিণের চামড়ার উপর লিখিত খ্রীস্টান ধর্মীয় নেতাদের কাছ থেকে আয়া সোফিয়া ক্রয়ের দলীল এখনও তুরস্কে সংরক্ষিত আছে। খ্রিস্টান ধর্মীয় নেতারা “আয়া সোফিয়া”কে বিক্রয় করতে সম্মত হওয়ার পর একজন সাধারণ মুসলমান হিসেবেই তিনি ওই সম্পদ ক্রয় করতে একটি ব্যক্তিগত চুক্তি স্বাক্ষর করেন তাদের সাথে, যেটির সাথে প্রশাসনিক কোনো সংশ্লিষ্টতা রাখেননি। লেনদেনটি ক্রয় ও স্বত্বত্যাগের একটি চুক্তির মাধ্যমে নথিভুক্ত করা হয়েছিল, এবং মূল্য পরিশোধের বিষয়টি ভাউচার দ্বারা প্রমাণিত।

এভাবেই “আয়া সোফিয়া” খ্রিস্টানদের কাছ থেকে ক্রয় করে নেওয়ার পরপরই আবুল ফতেহ সুলতান মোহাম্মদ (আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হউন) সেখানে একটি ওয়াকফ এসোসিয়েশন গঠন করেন এবং আয়া সোফিয়া ভবনটিকে তাদের মালিকানায় দান করে দেন এবং তিনি ওসিয়তনামা লিখে যান। যাতে নিম্নোক্ত কথাও লেখা ছিল- “এই ভিত্তি কেউ যদি পরিবর্তন করে, তার এবং তাদের উপরে আজীবন ধরে আল্লাহ পাকের, নবীজী (সা.) এর, ফেরেস্তাকূলের, সকল শাসকগণের এবং সকল মুসলমানের লানত পড়ুক! আল্লাহ পাক যাতে তাদের কবরের আজাব মাফ না করেন, হাশরের দিনে তাদের মুখের দিকে যাতে না তাকান! এই কথা শোনার পরেও কেউ যদি একে পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়ে যায়, পরিবর্তনের গুনাহ তার উপরে পড়ুক! আল্লাহর আজাব পড়ুক তাদের উপরে! আল্লাহ পাক সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।”– আবুল ফতেহ সুলতান মুহাম্মদ, (১লা জুন, ১৪৫৩)।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, আয়া সোফিয়াকে সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ বলপূর্বক তৎকালীন বাইজানটাইন ঈসায়ীদের কাছ থেকে কেড়ে নেননি, যা ঈসায়ী বিজয়ী শাসকেরা দখলকৃত স্থানে মুসলিমদের মসজিদগুলোর সাথে করেছেন। যেমন, স্পেনের কর্ডোভা। উপরোক্ত বিষয়গুলো পাশ্চাত্যের মিডিয়া এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্যে স্বীকার করতে নারাজ। তারা কেবল বলে বেড়াচ্ছে, ১৪৫৩ সালে সুলতান ফাতিহ বাইজানটাইন দখল করে ঈসায়ীদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সেন্ট সুফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুসলিম-সমাজের কিছু অংশ যারা বিষয়টি জানেন না, মনে করছেন, সুলতান ফাতিহ আয়া সোফিয়াকে বলপূর্বক গীর্জা থেকে মসজিদে রূপান্তরিত করেছেন। শুধু তাই নয়, পাশ্চাত্য সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহের বিজয়কে কালিমালিপ্ত করতে ইতিহাসবিকৃতিও ঘটিয়েছে। সবার মনে রাখা দরকার, ১৪৫৩ সালে সুলতানের বাইজানটাইন বিজয় সাধারণ কোন দেশ দখলের বিজয় নয়, বরঞ্চ পবিত্র হাদীসে বর্ণিত রসুলুল্লাহ সা.-র একটি গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যৎবাণীর বাস্তবায়ন। তাই সুলতান ফাতিহ তার অভিযানের পুরো সময়ে অমানবিক, অসুন্দর ও অন্যায় কোন আচরণ করেননি। পাশ্চাত্য উক্ত বিষয়টি জেনেই ইসলামের মহানবী সা.কে বিতর্কিত করতে সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রহ.-র অভিযান নিয়ে ইতিহাসবিকৃতি ঘটিয়েছে। উইকিপিডিয়ার সাম্প্রতিক ইংরেজি সংস্করণে Mosque (1453–1935) উপশিরোনামে বলা হচ্ছে: Constantinople fell to the attacking Ottoman forces on 29 May 1453. In accordance with the traditional custom at the time, Sultan Mehmet II allowed his troops and his entourage three full days of unbridled pillage and looting in the city shortly after it was captured. Once the three days passed, he would then claim its remaining contents for himself Hagia Sophia was not exempted from the pillage and looting and specifically became its focal point as the invaders believed it to contain the greatest treasures and valuables of the city. Shortly after Constantinople’s defenses collapsed and the Ottoman troops entered the city victoriously, the pillagers and looters made their way to the Hagia Sophia and battered down its doors before storming in. All throughout the period of the siege of Constantinople, the trapped worshippers of the city participated in the Divine Liturgy and the Prayer of the Hours at the Hagia Sophia and the church formed a safe-haven and a refuge for many of those who were unable to contribute to the city’s defense, which comprised women, children, the elderly and the sick and the wounded. Being hopelessly trapped in the church, the many congregants and yet more refugees inside became spoils-of-war to be divided amongst the triumphant invaders. The building was significantly desecrated and looted to a large extent, with the helpless occupants who sought shelter within the church being enslaved. While most of the elderly and the infirm/wounded and sick were killed, and the remainder (mainly teenage males and young boys) were chained up and sold off into slavery. [১৪৫৩ সালের ২৯শে মে উসমানীয় বাহিনীর আক্রমণের মুখে কনস্ট্যান্টিনোপোলের (কুসতুনতুনিয়া) পতন হলে সে সময়কার প্রথানুসারে দ্বিতীয় সুলতান মুহাম্মাদ তার বাহিনী ও সঙ্গী-সাথীদেরকে শহর-দখলের পর পূর্ণ তিন দিন পর্যন্ত লাগামহীন লুটতরাজ করে যেতে অনুমতি দেন। এভাবে তিন দিন অতিবাহিত হলে তিনি অক্ষত সম্পদগুলো নিজের বলে দাবি করতেন। আয়া সোফিয়াকেও লুটতরাজের হাত থেকে রেহাই দেয়া হয়নি। বিশেষ করে, আয়া সোফিয়াকে লুটতরাজের কেন্দ্রে পরিণত করা হয়। কারণ, হানাদাররা মনে করেছিলো: এটি শহরের সবচেয়ে দামি সম্পদ এবং এখানে মূল্যবান ধনরত্ন রয়েছে। কনস্ট্যানটিনোপোলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেঙ্গে যাবার পর উসমানীয় বাহিনী বিজয়ীর বেশে শহরে প্রবেশ করে; লুটতরাজকারীরা আয়া সোফিয়ার দিকে এগিয়ে যায় এবং লুটতরাজ চালাবার আগে তারা সদর দরোজা ভেঙ্গে ফেলে। কনস্ট্যানটিনোপোল দখলের পুরো সময় ধরে আয়া সোফিয়ায় নিয়মিত প্রার্থনাকারীরা আটকে পড়েছিলো এবং গীর্জাঘরটি বৃদ্ধ, অসুস্থ মানুষ, স্ত্রীলোক, শিশু আর যারা যুদ্ধে অংশ নিতে অসমর্থ ছিলো–তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় হিসাবে গড়ে ওঠে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে চার্চে যারা আটকা পড়েছিলেন, অনেক উপাসনাকারী, এমন কি ভেতরে আশ্রয় গ্রহণকারী–সবাই জয়ী হানাদারদের কাছে ‍যুদ্ধলব্ধ হিসাবে বণ্টিত হয়ে যায়। গীর্জাঘরটি ব্যাপকভাবে ধ্বংস ও লুণ্ঠিত হয়, চার্চের ভেতরে অসহায় আশ্রয় গ্রহণকারীদেরকে ক্রীতদাসে পরিণত করা হয়। সেখানে অক্ষম, আহত ও অসুস্থদেরকে হত্যা করা হয় এবং বাকি যারা ছিলো, বিশেষ করে তরুণ ও যুবক পুরুষদেরকে শিকলে বেঁধে দাস হিসাবে বিক্রি করে দেয়া হয়।]

আসলে কী ঘটেছিলো ১৪৫৩ সালের ২৯শে মে সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহের হাতে কুসতুনতুনিয়ার পতনের দিনে? আপাতত কোন মুসলিম লেখকের আশ্রয় না নিয়ে অমুসলিম কোন লেখকের তথ্য খুঁজতে সচেষ্ট হলাম। কিন্তু অধিকাংশের বর্ণনায় পাওয়া গেল তথ্য লুকানো বা বিকৃতির অপচেষ্টা। তাদের কণ্ঠে এক-ই কথা: কুসতুনতুনিয়া বিজয় করে সুলতান মুহাম্মাদ সেন্ট সুফিয়াকে মসজিদে পরিবর্তনের আদেশ দেন। সাথে উপরের লুটতরাজের ইঙ্গিত তো আছেই। চিন্তার রেখা কপালকে আক্রমণ করতে থাকলো অহরহ। ব্যক্তিগত সংগ্রহে এমন কিছু আছে কি না—সেটা খুঁজতে গিয়ে আল্লাহর মেহেরবানীতে পেয়ে গেলাম সত্তরের দশকে এক মার্কিন ঐতিহাসিক Stanford J. Shaw-র লেখা History of the Ottoman Empire and Modern Turkey গ্রন্থটি। লেখক স্ট্যানফর্ড জে. শ ক্যালিফোর্নিয়া য়ুনিভার্সিটির ইতিহাসের একজন অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর লেখা গ্রন্থটি একটি অন্যতম প্রামাণ্য উৎস হিসাবে খ্যাত। সেখানে তিনি লিখেছেন–“While Islamic law would have justified a full-scale sack and massacre of the city in view of its resistance, Mehmet kept his troops under firm control, killing only those Byzantines who actively resisted and doing all he could to keep the city intact so that it could be the center of his world empire. Many inhabitants and soldiers took refuge at the Genoese colony of Galata, across the Golden Horn, which had remained neutral during the siege. This violated its neutrality, but Zaganos made an agreement by which Galata was joined to the Ottoman Empire and its defenses torn down, in return for which its inhabitants were allowed to retain their holdings and gain freedom of religion and trade within the sultan’s dominions. The people of Galata were to retain their properties, but they were to have no tax or customs privileges other than the exemption of their children from the dev§irme tribute imposed in the Balkans.” (HISTORY OF THE OTTOMAN EMPIRE AND MODERN TURKEY, P-57, STANFORD SHAW, Professor of History University of California, Los Angeles, Reprinted: 1978, CAMBRIDGE UNIVERSITY PRESS, USA.)

[ ইসলামী আইন যেখানে সশস্ত্র প্রতিরোধের নিরিখে শহরে একটি পূর্ণমাত্রার আক্রমণের অনুমতি দেয়, সেখানে সুলতান মুহাম্মাদ তাঁর সৈন্যদেরকে পরিস্কার নিয়ন্ত্রণে রাখেন; হত্যা করেন কেবল সেসব বাইজানটাইনকে যারা সক্রিয়ভাবে উসমানীয় বাহিনীকে প্রতিরোধ করেছিলো এবং তিনি শহরটিকে তার সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে অক্ষত রাখতে সাধ্যমতো সব কিছুই করেছিলেন। অনেক বাসিন্দা ও সৈন্য গোল্ডেন হর্ন অতিক্রম করে গালাতার জেনোস কলোনিতে আশ্রয় নেয়, যেখানকার শাসক শহর দখলের সময় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাইজানটাইন সৈন্যরা সেখানে আশ্রয় নেয়ায় নিরপেক্ষতা লঙ্ঘিত হয়। কিন্তু শাসক জাগানোস এমন একটি চুক্তি করে যার মধ্য দিয়ে গালাতা উসমানীয় সাম্রাজ্যে যোগ দেয় এবং তাদের সৈন্যরা বৈশ্যতা মেনে নেয়। বিনিময়ে সুলতানের সাম্রাজ্যে গালাতের বাসিন্দারা তাদের বসতভিটা ফিরে পাওয়া, ধর্মীয় স্বাধীনতা অর্জন ও ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার পায়। গালাতের বাসিন্দারা তাদের সম্পদ ফিরে পায় এবং তাদের উপর কোন করও আরোপিত হয়নি।]

শুধু তাই নয়, স্ট্যানফর্ড জে. শ তাঁর গ্রন্থের ১৪৩ পৃষ্ঠায় আরও লিখেছেন– “While encouraging contact with the Christian heritage, the promotion of Ottoman Muslim culture remained Mehmet IPs primary aim. Thousands of abandoned and decayed Christian churches were rebuilt as mosques, and medreses were built around them to serve as centers for the new enlightened ulema congregating in Istanbul.” ( অর্থাৎ, খৃষ্টীয় ঐতিহ্যের সাথে যোগাযোগে উৎসাহ দেয়ার সময় সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহের প্রথম লক্ষ্য ছিলো, উসমানীয় সংস্কৃতির বিস্তার। হাজারের মতো পরিত্যক্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত গীর্জাকে মসজিদ হিসাবে পুনঃনির্মাণ করা হয়; ওগুলোর পাশে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সেগুলোর দেখভালের জন্য প্রখ্যাত আলিম-উলামাকে ইস্তাম্বুলে নিয়ে আসা হয়।) তাহলে দেখা যাচ্ছে, সুলতান ফাতিহ কুসতুনতুনিয়া দখলের পর সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য খৃষ্টীয় ঐতিহ্যকে ধ্বংস না করে সমন্বয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। আর যেসব গীর্জাকে তিনি মসজিদে পরিণত করেছিলেন, সেগুলো ছিলো আগে থেকেই পরিত্যক্ত বা ধ্বংসপ্রাপ্ত, যা দেখার জন্য ঈসায়ীদের কেউ ছিলো না। এমন উদাহরণ এখনও য়ুরোপে পাওয়া যাবে, পরিচর্যার অভাবে অনেক গীর্জা মুসলিমরা কিনে নিয়ে মসজিদে পরিণত করেছে। এখন আগামী এক শ’ বছর পরে কেউ যদি অভিযোগ করে বলে বসে: য়ুরোপের অমুক-অমুক চার্চকে মুসলিমরা মসজিদে পরিণত করেছে—সেটা সত্যের মাপকাঠিতে কতোটুকু গ্রহণযোগ্য হবে?

এভাবে আমরা দেখছি, ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়া ও কুসতুনতুনিয়া বিজয় নিয়ে পাশ্চাত্য প্রচুর মিথ্যাচার ও তথ্যবিকৃতি ঘটাচ্ছে। তারা, বিশেষভাবে ঈসায়ী ধর্মগুরুরা এমনভাবে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, মনে হতে পারে, সুলতান ফাতিহ জোরপূর্বক গীর্জা দখল করে মসজিদ বানিয়েছেন, সেখানে অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়েছেন ইত্যাদি…ইত্যাদি। উপরের আলোচনা এ জন্যই তুলে ধরলাম যেন পাঠক বুঝতে পারেন, পাশ্চাত্য-নেতারা ও মিডিয়া সুকৌশলে কী গোপন করছে। আমার আশ্চর্য লাগছে , ঈসায়ীদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস পর্যন্ত সব জেনেশুনে আয়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসাবে বহাল রাখার বিরোধিতায় নেমেছেন। এমন কি রাশিয়ার প্রভাবশালী বিশপ হিলারিয়নও মসজিদ হিসাবে আয়া সোফিয়ার বিরোধিতায় নেমে বলেছেন: এটা হবে বিশ্ব খৃষ্টান সম্প্রদায়ের জন্য এক আঘাত।(The influential bishop Hilarion, who heads the Russian Orthodox Church’s department for external church relations, also expressed his sorrow. “It is a blow to global Christianity … For us [Hagia Sophia] remains a cathedral dedicated to the Saviour,” he told. Aljazeera 12.07.2020) অথচ স্পেন আক্রমনের সময় কর্ডোভার কেন্দ্রীয় মসজিদকে যে বলপূর্বক চার্চে পরিণত করা হয়, য়ুরোপের শতশত মসজিদকে আস্তাবলে পরিণত করা হয়, সে বিষয়ে পুরো খৃষ্টান-জগৎ কিন্তু মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। এই হচ্ছে তাদের মুখোশের ভেতরের দিক।

মূলকথা হচ্ছে, আয়া সোফিয়া নামের মসজিদটি সাধারণ কোন মসজিদ নয়। এর সাথে জড়িত আছে মুসলমানদের বীরত্ব, আত্মমর্যাদাবোধ ও সভ্যতার দ্বারোম্মচনের অধ্যায়। তাই খৃষ্টান-জগতের মাথাব্যথা হলো, যদি আবারও মসজিদ হিসাবে
আয়া সোফিয়া মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, তবে একে কেন্দ্র করে মুসলিমরা পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে আরও বৃহৎ কোন জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে। হতে পারে আয়া সোফিয়ার আবেগকে অবলম্বন করে নতুন প্রজন্মের কোন সুলতান ফাতিহের জন্ম হবে। তাই, পাশ্চাত্য চায় না: মুসলমানরা আয়া সোফিয়ার ইতিহাসের রাস্তায় এ শতাব্দির নতুন কোন ক্রুসেড-বিজয় অর্জন করুক—যা কিনা কর্ডোভার মাযলূম মসজিদসহ হারানো সব মসজিদকে পুনরুদ্ধারের সংকল্পকে বাস্তব রূপ দান করবে। আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে বলতে পারি, এরদোগানের মহান উদ্যেগে আয়া সোফিয়া এমন এক মসজিদ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে, যার আযানের ধ্বনি এ যুগের মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে খিলাফাতে উসমানীয়ার স্বপ্নকে নতুন করে জাগরিত করবে।

প্রসঙ্গ: কুরবানী কিছু ভুল চিন্তার অপনোদন

0

শায়েখ সাজিদুর রহমান | মুহতামিম : জামিয়া দারুল আরকাম আল-ইসলামিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শায়খুল হাদিস : জামিয়া ইউনুছিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সহ সভাপতি : বেফাক


الحمد لله، والصلاة والسلام على رسول الله، وعلى آله وصحبه ومن والاه، أما بعد!
আজকের আমাদের আলোচ্য বিষয়টি অত্যন্ত নাযুক, স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল বিষয়। আমরা সবাই জানি, কুরবানী ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান এবং তা বিশেষ ধরণের ইবাদত। কুরবানী ইসলামের অন্যতম শিআ‘র তথা পরিচয়-নিদর্শনমূলক একটি ইবাদত। আযান, জুমআ‘, জামাআ‘ত ইত্যাদি যেমনিভাবে ইসলামের পরিচয় বহন করে তেমনি কুরবানীও ইসলামের পরিচয় বহন করে।

কুরবানী কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত ও রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। কুরআন মাজীদে যেমন এর বিধান এসেছে তেমনি হাদীস শরীফে এর ফযীলত, তাৎপর্য, মাসায়েলও পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয় বর্ণিত হয়েছে। এই জন্যই আমরা দেখি ফিকহ-ফতোয়ার কিতাবগুলোতে বেশ বিস্তৃত একটি অধ্যায় হলো, কিতাবুল উযহিয়াহ, কুরবানী সংক্রান্ত অধ্যায়।

তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, কুরবানীর মত এত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদতের ক্ষেত্রে এর বিকল্প অনুসন্ধান করা, এই ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাহানা তালাশ করা, এই ইবাদতকে ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করা; এগুলো হয় ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে অথবা ইসলামের প্রতি বিদ্বেষের কারণে। কারণ যেটাই হোক বিষয়টা মারাত্মক গুরুতর। এই সামান্য পরিসরে খুব বেশি বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ নেই। তবে এখানে কয়েকটি বিষয় সংক্ষেপে আলোচনা করা যায়।

এক.ঈদুল আযহার দিনে আমরা যে কুরবানী করে থাকি, সেই কুরবানীর নির্দেশনা কুরআন মাজীদে এসেছে نسك ও نحر শব্দে। সূরা আনআ‘মের ১৬২ আয়াতে نسك শব্দের অর্থ হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য আল্লাহর জন্য জবাইকৃত পশু। আর সবচেয়ে ছোট সূরা, সূরা কাওসারে نحر শব্দের অর্থ জবাই করা। نحر শব্দটির মূল ব্যবহার উট জবাইয়ের ক্ষেত্রে হলেও সাধারণ পশুজবাইকেও نحر বলা হয়। তাছাড়া এই কুরবানীর মূল সূত্র ‘মিল্লাতে ইবরাহীমী’র কুরবানী প্রসঙ্গেও সূরা ছাফ্ফাতে ১০৭ আয়াতে ذبحশব্দ এসেছে। অর্থ হলো, জবাইকৃত পশু।

তাহলে আমরা نسك, نحر,ذبح, এসব শব্দ থেকে বুঝতে পারি যে, কুরবানী আদায় হবে তখনই যখন যথাযোগ্য পশু আল্লাহর নামে জবাই করা হবে। পশু জবাইকরা ছাড়া কুরবানীর বিধান কোনোভাবেই আদায় হতে পারে না।
দুই.তিরমিযী শরীফের একটি হাদীস লক্ষ্য করুন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কুরবানীর দিন বান্দা যত আমল করে এর মধ্যে আল্লাহর কাছে বান্দার সবচেয়ে প্রিয় আমল হলো পশু জবাই করা।’
এরপরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, ‘কিয়ামতের দিন এসব কুরবানীর জন্তুগুলো শিং, পশম ও খুর সহ (জীবিত হয়ে) উপস্থিত হবে।’এর অর্থ হলো, কুরবানী কবুল হলে আখেরাতে বান্দার নাজাত লাভের ওসীলা হতে পারে কুরবানী।

হাদীস শরীফে এর পরের অংশ হলো, ‘কুরবানীর পশুর রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে কবুলিয়াতের এক বিশেষ অবস্থানে পৌঁছে যায়।’

একেবারে সর্বশেষ বাক্যটি হলো, ‘সুতরাং তোমরা আনন্দের সঙ্গে কুরবানী করো।’

আমাদের আলোচ্য বিষয়ে এই হাদীসটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এর প্রতিটি অংশই আমাদের মনোযোগের দাবী রাখে। দেখুন, পুরো হাদীসের সবকটি অংশ জুড়েই মূল বার্তা হলো, কুরবানীর দিন আল্লাহর নামে কুরবানীর পশু জবাই করাই হলো ইবাদত। আর এই ইবাদতই আল্লাহর সন্তুষ্টিঅর্জনের উপায় ও বান্দার আখেরাতে নাজাত লাভের উপায়।

তিন. অনেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কীভাবে কুরবানী করেছেন। কী নিয়ত করেছেন, কেমন পশু সংগ্রহ করেছেন, কুরবানীর সময় কী দুআ‘ করেছেন ইত্যাদি সব হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত উম্মতের মধ্যে এই ইবাদত অবিচ্ছিন্ন ধারায় তাওয়াতুর ও তাওয়ারুসের সাথে একটি শিআ‘ররূপে মুসলমানদের সম্মিলিত ও সুপ্রকাশ্য ইবাদত হিসাবে চলমান আছে। অতএব কেউ যদি কুরবানীর বিধান পালনে বাহানা তালাশ করে তবে সে নিশ্চিতই শরীয়ত অস্বীকারকারী।

চার.কুরবানী যেদিন করা হয় সেই দিনের নাম হাদীস শরীফে এসেছে يوم الأضحى, আরো এসেছে يوم النحر। দুনো শব্দের অর্থের মধ্যে আল্লাহর নামে ইবাদত হিসাবে পশু জবাইয়ের বিষয়টি রয়েছে। তাহলে পশু জবাই ছাড়া কুরবানী কীভাবে হতে পারে?

পাঁচ. যেহেতু কুরবানী ইসলামের একটি ইবাদত সুতরাং নিছক পশু জবাই কোনোভাবেই কুরবানীর উদ্দেশ্য হতে পারে না। তেমনি শুধুই উৎসবের গোশতের প্রয়োজন পূরণের জন্যও কুরবানী নয়। তাহলে তো আর কুরবানীর ক্ষেত্রে এত নিয়ম-কানুন, এত এত মাসআলা-মাসায়েলের প্রয়োজন হতো না। কুরবানীর পশু এমন হতে হবে, এমন হলে হবে না, এই সময়ের মধ্যে কুররবানী করতে হবে, এর আগে-পরে করলে হবে না, ইত্যাদির প্রয়োজন হতো না।
গোশত খাওয়ার জন্যই যদি কুরবানী হতো তাহলে তো কুরবানীর ক্ষেত্রে ইখলাসের শর্ত থাকতো না। এই শর্ত থাকতো না যে, শরীকদের একজনও যদি গোশত খাওয়ার নিয়ত করে তাহলে কারোই কুরবানী হবে না।

তাহলে বোঝা গেলো, কুরবানীর মধ্যে মূল হলো ইবাদত। তবে আল্লাহই এই বিধান দিয়েছেন, নিয়মমতো শরীয়ত মুতাবেক কুরবানী হওয়ার পরে কুরবানীর গোশত নিজেরাও ভোগ করতে পারবে। আত্মীয়-স্বজনকেও দেবে এবং দরিদ্রদেরকেও দান করবে।

ছয়. যেহেতু কুরবানী ইসলামের একটি ইবাদত, সেহেতু অন্যান্য ইবাদতের মত এই ইবাদতও কাদের উপর ওয়াজিবএবং কাদের উপর ওয়াজিব নয়, কোন পরিস্থিতিতে ওয়াজিব ও কোন পরিস্থিতিতে ওয়াজিব নয় ইত্যাদি বিষয় ইসলামে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে। সুতরাং এখানে বিষয়টা কাউকে চাপিয়ে দেওয়ার মত বিষয় নয়। এই বিষয়ে কারো অস্পষ্টতা থাকবার কথা না। এখানে আরেকটি বিষয়, আচ্ছা, দেশে কি দৈনিক হাজার হাজার গরু, মহিষ, ছাগল ইত্যাদি জবাই হচ্ছে না? বাজারে কি গোশত বিক্রি হচ্ছে না? তাহলে কুরবানীর বিষয়টাকে ভিন্ন রকম সেন্টিমেন্ট দিয়ে বিচার করা হচ্ছে কেন?

সাত.বর্তমানে করোনা-পরিস্থিতির কারণে অর্থনীতির বেহাল অবস্থার কথা সবারই জানা আছে। কিন্তু আমরা সবাই জানি, দেশের খামারীরাসহ লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন-জীবিকার বড় একটা মৌসুম হলো কুরবানীর সময়। এই সব লোকজনের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষ। এখন কুরবানীর ক্ষেত্রে সামর্থ্যবানদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভাটা পড়লে এতে বিপুল এই জনগোষ্ঠী মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে।

আট. কারো কারো পক্ষ থেকে কুরবানীকে কেন্দ্র করে অধিক হারে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা ব্যক্ত হচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের বক্তব্য হলো, দেশে প্রয়োজনীয় কাজগুলো কি থেমে আছে? হাট-বাজার কি এখন বন্ধ হয়ে আছে? রাস্তা-ঘাটে কি গাড়ী-যানবাহন কম চলে? তাহলে শুধু জামাত, জুমআ‘ ও কুরবানী নিয়েই এত আশঙ্কা? হ্যাঁ, কীভাবে সতর্কতার সাথে কুরবানীর এই ইবাদতটুকু পালন করা যায় সবারই সচতেন হওয়ার প্রয়োজন আছে।
নয়.বলা হচ্ছে, কুরবানীর অর্থ দরিদ্রদেরকে বিতরণ করে দেওয়া অধিক শ্রেয়। এখানে আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, দরিদ্রদের সহযোগিতার প্রসঙ্গে এক শ্রেণীর মানুষ শুধু হজ¦-কুরবানীর মত ইসলামী ইবাদতগুলোকে নিয়ে আসেন কেন? খেলাধূলা, মদ-জুয়া, অশ্লীল বিনোদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সীমাহীন অপচয়ের প্রসঙ্গে তারা একটি শব্দও ব্যয় করেন না কেন? আমরা মনে করি, এই শ্রেণীটির পরিচয় সম্পর্কে কোনো ঈমানদারের সংশয় থাকা উচিত না। তাছাড়া দেশের মানুষ জানে, দরিদ্রদের কঠিন সময়ে ধর্মপ্রাণ আল্লাহমুখী মানুষজনই সবার আগে সবসময় এগিয়ে আসে।

দশ. সবশেষে কথা এই যে, করোনার মহামারি থেকে আমাদের পরিত্রাণ লাভের অন্যতম উপায় হতে পারে ইসলামের এই ইবাদতটি আরো অনেক বেশি জযবা ও উদ্দীপনা নিয়ে, অনেক বেশি ইখলাস ও আল্লাহমুখিতা নিয়ে পালন করা। এই ইবাদতের মাধ্যমে আমরা যেন সাইয়িদুনা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও সাইয়িদুনা হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের মতো আল্লাহর বিধানের সামনে সমর্পিত হতে পারি, সেই চেষ্টা করা।
কয়েকটি কথা আরজ করা হলো। আল্লাহ যেন আমাদেরকে কবুল করেন। আমীন।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর শারীরিক অবস্থার ফের অবনতি

0

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) পরবর্তী সেকেন্ডারি নিউমোনিয়ায় ভুগছেন। দীর্ঘ একমাস রোগে ভোগায় তার শরীর দুর্বল। স্বরতন্ত্রের প্রদাহের কারণে তার কথা বলা নিষেধ।

মঙ্গলবার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়েছে।

এতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এম আবদুল্লাহ সোমবার সকালে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে দেখতে এসেছিলেন।

করোনাভাইরাসের কিটের অনুমোদন না পাওয়ায় বিষণ্ণ গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি।

তবে ওষুধ প্রশাসন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল কিট উন্নয়নে সহযোগিতা করবে জানতে পেরে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কিটের উন্নয়নে কাজ করছে। উন্নয়নকৃত কিট অনুমোদন পাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বিএসএমএমইউ এন্টিজেন কিট পরীক্ষার কাজ শুরু করবে বলেও মনে করেন তিনি।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র শিগগিরই কভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য আইসিইউ চালু করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অসুস্থতার মধ্যেও অর্থ জোগাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ডা. জাফরুল্লাহ। হাসপাতালে বসেই গণস্বাস্থ্যের সকল প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছেন।

গত ২৫ মে করোনায় আক্রান্ত হন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। গণস্বাস্থ্য উদ্ভাবিত কিটেই তার করোনা ধরা পড়ে বলে জানান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসকরা। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিসিআর ল্যাবে পরীক্ষাতেও তিনি করোনা পজিটিভ হন। এরপর ১৩ জুন তিনি করোনা থেকে সেরে উঠেন।