ভারতের ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, মেঘালয়ের (ইউএসটিএম) চ্যান্সেলর মাহবুবুল হককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যদিও তার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ এখনো স্পষ্ট নয়, তবে বিশ্লেষকদের মতে, তিনি মুসলিম হওয়ায় এবং সংখ্যালঘু পরিচালিত একটি সফল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কারণে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার প্রশাসন তাঁকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে টার্গেট করছে।
শনিবার স্থানীয় সময় রাত ২টার দিকে ভারতের আসাম রাজ্যের গুয়াহাটি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রতিবেদন অনুসারে, আসামের পনবাজার থানা ও স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) যৌথভাবে মাহবুবুল হককে গ্রেপ্তার করেছে।
এই গ্রেপ্তার এমন সময় এলো, যখন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা মুসলিম পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে লাগাতার ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলছেন।
গত বছর তিনি ইউএসটিএমের বিরুদ্ধে “ফ্লাড জিহাদ” চালানোর অভিযোগ তোলেন, যেখানে তিনি দাবি করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম গুয়াহাটিতে বন্যার জন্য দায়ী।
এছাড়া, মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন যে, ইউএসটিএম ভুয়া ডিগ্রি বিতরণ করছে এবং মাহবুবুল হক অবৈধভাবে ওবিসি সার্টিফিকেট নিয়েছেন।
তবে বাস্তবে, এই অভিযোগগুলোর পক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই, এবং ইউএসটিএম কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
মেঘালয় সরকার ও ইউএসটিএম প্রশাসন এই অভিযোগকে সরাসরি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে আখ্যা দিয়েছে।
মেঘালয়ের প্রধান সচিব ডোনাল্ড পি ওয়াহলাং বলেছেন, “ইউএসটিএম বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দ্বারা স্বীকৃত এবং এটি মেঘালয় প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি রেগুলেটরি বোর্ড (এমপিইউআরবি)-এর বিধি অনুযায়ী পরিচালিত। ভুয়া ডিগ্রির অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।”
ইউএসটিএমের জনসংযোগ কর্মকর্তা বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০১১ সাল থেকে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও সামাজিক কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। এই ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ণ করছে না, বরং ভারতের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার শীর্ষ সংস্থাগুলোর গ্রহণযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।”
মুসলিম মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান টার্গেট?
বিশ্লেষকরা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার প্রশাসন মুসলিম মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ধারাবাহিক বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করছে। হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সরকার মুসলিম পরিচালিত মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করেছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক অভিযোগ তুলেছে, যার মধ্যে ইউএসটিএমও অন্যতম। “ফ্লাড জিহাদ” ও “ভুয়া ডিগ্রি বিতরণ” সংক্রান্ত অভিযোগ মুসলিম মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার একটি প্রচেষ্টা হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
এছাড়া, কিছু সূত্র জানিয়েছে যে আসামের মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী একটি নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা করছেন। তাই অনেকে মনে করছেন, ইউএসটিএমকে টার্গেট করা হচ্ছে যাতে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের শিক্ষাব্যবসা সহজ হয়।
অভিযোগের বিপরীতে ইউএসটিএমের উল্লেখযোগ্য শিক্ষাগত অর্জন রয়েছে।
২০২১ সালে জাতীয় মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি পরিষদ (এনএএসি) থেকে ‘এ’ গ্রেড পেয়েছে। ভারতের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের র্যাঙ্কিংয়ে পরপর তিন বছর উত্তর-পূর্ব ভারতের সেরা ২০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে। “নেচার ইনডেক্স” অনুসারে গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইউএসটিএম ভারতের ৫২তম স্থান অর্জন করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও পিএইচডি কার্যক্রম কঠোর মানদণ্ড অনুসরণ করে, যা ভারতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় আরও কঠোর। ইউএসটিএমের কর্মকর্তা ও শিক্ষকরা এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, “আমরা ইউএসটিএমের বিরুদ্ধে আনা ভিত্তিহীন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছি। এই ধরনের অপপ্রচার কেবল একটি স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে না, বরং হাজারো শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও গবেষকদের মনোবল দুর্বল করছে।”
তারা আরও বলেন, “আমরা যেকোনো উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের তদন্তকে স্বাগত জানাই, যাতে প্রকৃত সত্য সবার সামনে স্পষ্ট হয়।”
মাহবুবুল হকের গ্রেপ্তারের ফলে আবারও ইউএসটিএম ও আসাম সরকারের সংখ্যালঘু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্তিশালী শিক্ষাগত স্বীকৃতি এবং মেঘালয় সরকারের সমর্থনের কারণে এই অভিযোগগুলো আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।
আসাম পুলিশ এখনও মাহবুবুল হকের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ স্পষ্ট করেনি, তবে অনেকেই মনে করছেন, এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং মুসলিম পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দমন নীতির অংশ।
এই গ্রেপ্তার বিচারিক পদক্ষেপের দিকে এগিয়ে যাবে, নাকি এটি একটি চলমান রাজনৈতিক চক্রান্তের অংশ, সেটি সময়ই বলে দেবে।
সূত্র : মুসলিম মিরর