ভারতের সঙ্গে চলমান উত্তেজনা ও দ্বিপাক্ষিক বিরোধের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় হস্তক্ষেপ দাবি করেছে। ইসলামাবাদের উচ্চ পর্যায়ের একটি কূটনৈতিক প্রতিনিধি দল রবিবার লন্ডনে পৌঁছে স্পষ্টভাবে জানায়, দক্ষিণ এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে চলমান উত্তেজনা শুধু আঞ্চলিক নয়, বরং বৈশ্বিক শান্তির জন্যও হুমকি তৈরি করছে। এই অবস্থায় বিশ্বশক্তিদের নিরব দর্শক না থেকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখা উচিত।
এই প্রতিনিধি দলে আছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারি, হিনা রব্বানি খার, খুররম দস্তগীর, সিনেটর শেরি রেহমান, মুসাদ্দিক মালিক, ফয়সাল সবজওয়ারি ও বুশরা আনজুম বাট। এছাড়াও ছিলেন কূটনীতিক জালিল আব্বাস জিলানি ও তাহমিনা জানজুয়া।
যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে যুক্তরাজ্যে পৌঁছে প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য খুররম দস্তগীর বলেন, “আমরা ওয়াশিংটনে যে আপত্তির মুখে পড়েছি, তা হলো আমেরিকানরা মনে করেন যেহেতু ট্রাম্প যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করেছেন, তাই আর হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। অথচ এটাই ছিল আমাদের মিশন, তাদের বোঝানো যে এখনো হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “ভারতের পক্ষ থেকে যদি আলোচনার উদ্যোগ না আসে এবং পানি নিয়ে আগ্রাসী অবস্থান ও যুদ্ধোন্মাদনা বজায় থাকে, তাহলে এই উপমহাদেশে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।”
সিনেটর ফয়সাল সবজওয়ারি বলেন, “বিশ্বশক্তিগুলোর দায়িত্ব ভারতকে বোঝানো, এই অঞ্চলের দুই পারমাণবিক শক্তির মধ্যে এমন উত্তপ্ত পরিবেশ মানবজাতির জন্য হুমকি। শুধু এশিয়া নয়, এটি বিশ্বের নিরাপত্তাকেও চ্যালেঞ্জ করে।”
সিনেটর শেরি রেহমান আলোচনাগুলোকে “খুব ইতিবাচক” আখ্যা দিয়ে বলেন, “আমরা যুদ্ধ নয়, শান্তির বার্তা নিয়ে এসেছি। যুক্তরাষ্ট্রসহ সংশ্লিষ্টরা পানির অস্ত্রায়নের বিপজ্জনক পরিণতি সম্পর্কে অবগত হয়েছেন। ভারত-অধিকৃত কাশ্মীর আজ গাজার পর বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “ভারতীয় দলগুলো বিশ্বজুড়ে আমাদের বিরুদ্ধে প্রচারণায় ব্যস্ত। কিন্তু আমরা কারও বিরুদ্ধে নয়, পাকিস্তানের বাস্তবতা তুলে ধরতেই এসেছি।”
সিনেটর বুশরা বাট বলেন, “কাশ্মীর ও ইন্দাস জলচুক্তি নিয়ে আমাদের উদ্বেগে নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে শক্ত প্রতিক্রিয়া এসেছে। যদি ইন্দাস ট্রিটি আজ অবজ্ঞায় পড়ে, ভবিষ্যতের কোনো চুক্তিরও মান থাকবে না।”
পাকিস্তানের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিলানি বলেন, “আমরা শান্তির বার্তা নিয়ে এসেছি। আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট, ভারত আগ্রাসন করেছে, আর পাকিস্তান শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খোঁজে।”
৪ জুন বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারির নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দল নিউইয়র্ক সফর শেষ করে, যেখানে তারা জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এবং নিরাপত্তা পরিষদের নির্বাচিত ও স্থায়ী সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করে। পরবর্তীতে ওয়াশিংটনে তারা মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যানসহ গুরুত্বপূর্ণ আইনপ্রণেতা ও বিভিন্ন থিঙ্কট্যাঙ্কের সঙ্গে আলোচনা করে।
আরেকটি প্রতিনিধি দল, যার নেতৃত্বে আছেন প্রধানমন্ত্রী বিশেষ সহকারী সৈয়দ তারিক ফতেমি, ২ থেকে ৪ জুন মস্কো সফরে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ও প্রেসিডেন্ট পুতিনের একজন সিনিয়র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন।
অন্যদিকে ভারতও একই সময় সাত সদস্যের সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল বিভিন্ন দেশের সফরে পাঠিয়েছে। কংগ্রেস এমপি শশী থারুরের নেতৃত্বে ওই দলটি মার্কিন সিনেট, নিরাপত্তা পরিষদ ও অন্যান্য মিত্রদেশে ভারতের অবস্থান তুলে ধরছে। দলের সদস্যরা ৫ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স-এর সঙ্গে বৈঠক করে, যিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত।
তারা মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্র ও গোয়েন্দা কমিটির সদস্যদের সঙ্গেও বৈঠক করেছে। এর মধ্যে ছিলেন ডেভ ম্যাককরমিক, জ্যাকি রোজেন, জিম রিশ, মার্ক ওয়ার্নার, জন করনিন ও এলিসা স্লটকিন।
ভারতের প্রতিনিধি দলে রয়েছেন লোক জনশক্তি পার্টির শাম্ভাবি চৌধুরী, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সরফরাজ আহমেদ, তেলেগু দেশম পার্টির জি. এম. হরিশ বালয়োগি, বিজেপির শশাঙ্ক মণি ত্রিপাঠি, তেজস্বী সূর্য ও ভূবনেশ্বর কলিতা, শিবসেনার মল্লিকার্জুন দেবদা, সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত তারণজিৎ সিং সান্ধু এবং এমপি মিলিন্দ দেওরা।
বিশ্বপরিসরে পাকিস্তান ও ভারতের এই দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক তৎপরতা এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক ধরনের কূটনৈতিক প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে। শান্তির বার্তা ও রাজনৈতিক অবস্থান, উভয় পক্ষই নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে সচেষ্ট।
সূত্র : ডন