বৃহস্পতিবার, জুন ১২, ২০২৫

তুরস্কবিরোধী প্রচারণা চালালেও বাণিজ্য বন্ধ করার সাহস করছে না মোদি সরকার

spot_imgspot_img

তুরস্কের পাকিস্তানপন্থী অবস্থানের বিরোধিতা করে ভারতে “তুরস্ক বর্জন” আন্দোলন জোরালো হলেও, ইসলামবিরোধী অবস্থানে বরাবরই সরব ভারতীয় প্রশাসন শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক স্বার্থের কাছে নিজেদের কথিত জাতীয় নিরাপত্তার কথাও ভুলে যাচ্ছে। তুরস্ক থেকে বারবার মুসলিম বিশ্বের পক্ষে সাহসী অবস্থান আসায় রাজনৈতিকভাবে ক্ষিপ্ত হলেও, বাণিজ্যিক লোভের কারণে দেশটি কোনো ধরনের আমদানি নিষেধাজ্ঞা আরোপে রাজি হচ্ছে না।

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস–এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ভারত সরকার এখনই তুরস্কের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে প্রস্তুত নয়। যদিও কয়েকটি ক্ষেত্র বিশেষে তুর্কি কোম্পানিকে সীমিত করা হয়েছে, তথাপি পূর্ণাঙ্গ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে ভারতের রপ্তানি খাতেই আঘাত আসবে বলে কর্তৃপক্ষ সতর্কবার্তা দিয়েছে।

তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ভারত তুরস্কের সঙ্গে ২.৭৩ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত উপভোগ করেছে। যার ফলে মুসলিমবিরোধী তর্জনগর্জন চললেও আমদানিতে বাঁধা দেওয়ার সাহস দেখাতে পারছে না মোদি সরকার।

হিমাচলের আপেলচাষি থেকে শুরু করে রাজস্থানের মার্বেল ব্যবসায়ী, তুরস্কবিরোধী এই আন্দোলনের পিছনে রয়েছে হিন্দুত্ববাদী চেতনার বাণিজ্যিক রূপ। আপেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার দাবি জানিয়ে চাষিরা বলছেন, তুর্কি আপেল স্থানীয় বাজারে প্রভাব ফেলছে। আবার ‘অপারেশন সিধুর’-এর সময় পাকিস্তানের প্রতি তুরস্কের সমর্থনের কথা তুলে ধরে মার্বেল আমদানি বন্ধের দাবি জানিয়েছে কিছু চক্র।

তবুও ভারতের এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, “আমরা তুরস্ক থেকে আমদানি বন্ধের বিষয়ে অনুরোধ পেয়েছি। কিন্তু আমরা বাণিজ্য উদ্বৃত্তে রয়েছি, আমাদের রপ্তানিকারকদের স্বার্থ দেখতে হবে। এটা একটি ভূরাজনৈতিক বার্তা হতে পারে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি সেটাকে কতদূর নিতে চান।”

এই বক্তব্যে ভারতের দ্বিচারিতাই স্পষ্ট, একদিকে ‘পাকিস্তানপন্থী’ বলে হুমকি, অন্যদিকে সেই দেশের বাজারেই রপ্তানি থেকে অর্থ কামাই।

ভারত সরকার যতই জনমনে তুরস্কবিরোধী আবেগ উসকে দিক না কেন, বাস্তবতা হলো, দেশটি তুরস্কে প্রচুর পণ্য রপ্তানি করে চলেছে। ২০২৪–২৫ সালে তুরস্কে ভারতের রপ্তানি ছিল ৫.৭২ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে কেবল ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যই ছিল ৩ বিলিয়নের বেশি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত থেকে এসেছে প্রায় ৪০ শতাংশ পণ্য।

অপরদিকে, তুরস্ক ভারতকে যে পণ্য রপ্তানি করে তা কিছু নির্দিষ্ট খাতে সীমিত, ফলমূল, বাদাম, মার্বেল ও স্বর্ণ।

ভারতের উদয়পুরের মার্বেল ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রী মোদির দপ্তরে চিঠি দিয়ে দাবি জানিয়েছে, পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তুরস্কের মার্বেল নিষিদ্ধ করা হোক। ভারতের তথাকথিত ‘অপারেশন সিনদূর’-এ পাকিস্তানের প্রতি তুরস্কের সমর্থনের কারণেই তারা এই দাবি তুলেছে।

তবে এই অবস্থান মোটেও নিঃস্বার্থ নয়। বরং তুরস্ক থেকে আমদানি করা মার্বেলই ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।

ইউক্রেন যুদ্ধের পর তুরস্ক ভারতে কিছু পরিমাণ পেট্রোলিয়াম রপ্তানি করলেও চলতি অর্থবছরে সেই পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে।

এছাড়া, গত মাসে তুরস্কের প্রতিষ্ঠানের একটি ভারতীয় শাখা ‘চেলেবি এভিয়েশন’-এর নিরাপত্তা ছাড়পত্র বাতিল করেছে ভারতের বিমান নিরাপত্তা সংস্থা বিসিএএস। যদিও বম্বে হাই কোর্ট এতে হস্তক্ষেপ করে বিষয়টি জুন মাস পর্যন্ত স্থগিত রাখে।

তুরস্ক ও আজারবাইজানের পাকিস্তানপন্থী অবস্থানে ক্ষুব্ধ ভারতীয়রা এখন মধ্য এশিয়ার অন্য দেশে ঘুরতে যাচ্ছেন, যেমন কাজাখস্তান ও উজবেকিস্তান। ২০২৪ সালে তুরস্কে ৩ লাখ ও আজারবাইজানে ২.৪৪ লাখ ভারতীয় পর্যটক গিয়েছিল।

সমগ্র ঘটনায় ভারতের দ্বিচারিতা স্পষ্ট, তুরস্কের মুসলিমপন্থী অবস্থান ও পাকিস্তানঘেঁষা নীতির সমালোচনা করে রাজনৈতিক প্রচারণা চালালেও, নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে সেই দেশ থেকেই পণ্য আমদানি ও রপ্তানি চালিয়ে যাচ্ছে। একদিকে ‘সিকিউরিটি থ্রেট’, অন্যদিকে ‘ট্রেড বেনিফিট’ এই দুই মুখোশ পরেই চলছে ভারতের তথাকথিত কূটনীতি।

সূত্র : দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

সর্বশেষ

spot_img
spot_img
spot_img