পরাজিত শক্তি, ফ্যাসিস্ট ও টেরোরিস্টদের অপচেষ্টা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ করে দেওয়া হবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, ভয় দেখিয়ে, সন্ত্রাস ঘটিয়ে বা রক্ত ঝরিয়ে এ দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা কেউ থামাতে পারবে না। যারা অস্থিরতা তৈরি করতে চায়, আমরা অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের মোকাবিলা করব।
মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
সবাইকে সংযম বজায় রাখা ও অপপ্রচার বা গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তাদের ফাঁদে পা দেবেন না। পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি এ দেশের পবিত্র মাটিতে আর কোনোদিন ফিরে আসবে না।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে ওঠা স্বাধীনতার নতুন সূর্য স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদে ম্লান হয়েছিল। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা আবার একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত, স্বাধীন ও সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়েছি।
শরীফ ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় অত্যন্ত ব্যথিত জানিয়ে তিনি বলেন, এটি শুধু একজন ব্যক্তির ওপর আঘাত নয়; এটি বাংলাদেশের অস্তিত্বের ওপর আঘাত, আমাদের গণতান্ত্রিক পথচলার ওপর আঘাত। সরকার এ ঘটনাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। হামলায় জড়িতদের প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা গেছে। যারা এ ষড়যন্ত্রে জড়িত, তারা যেখানেই থাকুক না কেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
তিনি আরও বলেন, এখন তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেগুলো হলো জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার, একটি জবাবদিহিমূলক ও কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রকাঠামোর প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। অন্তর্বর্তী সরকার উন্নত ও সুশাসিত দেশের শক্তিশালী ভিত গড়তে বিস্তৃত সংস্কার কর্মসূচি নিয়েছে, জনগণের সম্মিলিত অংশগ্রহণে তার সফল পরিসমাপ্তির পথে নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি সাধারণ নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠিত হবে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এ লক্ষ্যে যাবতীয় প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হয়েছে। সরকার নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিচ্ছে। আমরা চাই এ নির্বাচন হোক সত্যিকারার্থে উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ এবং সর্বোপরি সুষ্ঠু। নির্বাচনকে ঘিরে নিরাপত্তা, প্রশাসনিক প্রস্তুতি, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং পর্যবেক্ষণের সব ধাপকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি বলেন, ভোটের ওপর নির্ভর করছে আপনার আমার সবার ভবিষ্যৎ। আপনার আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ। যোগ্য লোককে ভোট দিন। জাতির ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করুন। মনে রাখবেন, ভোট রক্ষা করা দেশ রক্ষা করার সমান দায়িত্ব। ভোট রক্ষা করুন, দেশকে রক্ষা করুন। ভোট দেশকে এগিয়ে নেওয়ার গাড়ির চাকা। এ চাকা কাউকে চুরি করতে দেবেন না।
ড. ইউনূস বলেন, আমরা কোন ধরনের রাষ্ট্র প্রত্যাশা করি তা নির্ভর করবে গণভোটের ফলাফলের ওপর। এ ভোটের মাধ্যমে ঠিক হবে নতুন বাংলাদেশের চরিত্র, কাঠামো ও অগ্রযাত্রার গতিপথ। নতুন বাংলাদেশ গঠনের দায়িত্ব সবার। আপনাদের মূল্যবান ভোটই আমাদের রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। তাই ভোটকে শুধুই কাগজে একটি সিল মারার আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে দেখবেন না; বরং এটি হবে নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণে আপনার সক্রিয় অংশগ্রহণ, গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা এবং দেশকে এগিয়ে নিতে সরাসরি অবদান। দেশের মালিকানা আপনাদের হাতে, আর সে মালিকানারই স্বাক্ষর আপনার ভোট।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি দেশের সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রতি উন্মুক্ত আহ্বান জানাচ্ছিÑআপনারা একে অপরকে প্রতিযোগী হিসেবে দেখবেন, কখনো শত্রু হিসেবে দেখবেন না। নির্বাচনের মাঠে এমন একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করুন, যাতে দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আরো আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। যারা ভোটের বাক্স ডাকাতি করবে, তারা দেশের মানুষের স্বাধীনতা হরণকারী। তারা নাগরিকদের দুশমন। তাদের থেকে নাগরিকদের রক্ষা করা সবার অবশ্য কর্তব্য।
জুলাই সনদ জাতির ভবিষ্যৎ পথযাত্রায় ঐতিহাসিক দলিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ সনদে আমরা যে সংস্কারমালা প্রস্তাব করেছিÑরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন, প্রশাসনিক জবাবদিহিতা, দুর্নীতি হ্রাস, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং সমাজে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা; এসব বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন জনগণের সুস্পষ্ট মতামত।
দেশের তরুণদের রক্ষা করার আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, যারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে তারা বুঝে গেছে তরুণ যোদ্ধারা তাদের পুনরুত্থানের পক্ষে ভীষণ রকম বাধা। এ অস্ত্রহীন, ভীতিহীন, ব্যক্তিগত স্বার্থ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন দৈনন্দিন এ চেহারার ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাদের সাংঘাতিক ভীতি। তাদের লক্ষ্য হলো নির্বাচন আসার আগেই পথের এ বাধাগুলো সরিয়ে ফেলা, নিজেদের রাজত্ব আবার কায়েম করা। তাদের বন্ধুরা যতদিন তাদের সঙ্গে আছে, ততদিন তারা এ স্বপ্ন দেখবে। নির্বাচন হলে তাদের বন্ধুরা সমর্থন জোগাতে বেকায়দায় পড়বে। সেজন্যই তো এত তাড়াহুড়া। তারা চায় নির্বাচনের আগেই তাদের ফিরে আসা নিশ্চিত করতে। নানা ভঙ্গিতে এটা তারা করবে। এ চোরাগোপ্তা খুন করার উদ্যোগ তার একটি রূপ। আরো কঠিনতর পরিকল্পনা নিয়েও তাদের প্রস্তুতি আছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জাতীয় নেত্রী ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব হিসেবে বর্ণনা করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তিনি বর্তমানে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। বিষয়টি আমাদের সবার জন্যই উদ্বেগের বিষয়। খালেদা জিয়ার অসুস্থতার বিষয়টি শুরু থেকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। তিনি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের প্রতি তার অবিচল অঙ্গীকার, দেশের উন্নয়নে তার অবদান এবং তার প্রতি জনগণের শ্রদ্ধাময় আবেগ বিবেচনায় নিয়ে সরকার ইতোমধ্যে তাকে রাষ্ট্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। তার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পরিবারের ইচ্ছাকে সম্মান দেখিয়ে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। দেশে চিকিৎসার পাশাপাশি প্রয়োজনে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ সব বিষয় বিবেচনায় আছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের নির্দেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি মামলার রায় হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল স্বাধীন ও স্বচ্ছ। প্রমাণভিত্তিক বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের ছাত্র, শ্রমিক ও সাধারণ জনগণের ওপর নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের প্রধান নির্দেশদাতা হিসেবে হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অভ্যুত্থানের পর পলাতক হাসিনা এবং ওই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত অপর আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে দেশে ফেরানোর জন্য সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে।










