রাষ্ট্রের দ্বিমুখী আচরণ, আলেম–ওলামা ও মাদরাসা ছাত্রদের টার্গেট করে গ্রেফতার এবং কর্পোরেট মিডিয়া–নিয়ন্ত্রিত বৈষম্যমূলক বয়ানের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছে ইন্তিফাদা বাংলাদেশ। সংগঠনটির দাবি, আইন প্রয়োগের নামে নির্দিষ্ট পরিচয় ও মতাদর্শকে নিশানা বানিয়ে অভিযান চালানো নাগরিক অধিকারের জন্য গুরুতর হুমকি এবং কথিত নতুন বাংলাদেশের দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
লিখিত বিবৃতিতে ইন্তিফাদা বাংলাদেশ বলেছে, “আমরা কোনো সংবাদমাধ্যমের ওপর হামলা সমর্থন করি না। প্রচলিত আইন ভঙ্গ হলে নিয়মতান্ত্রিক তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুরাহা হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাষ্ট্র ‘রুল অফ প্রোফাইল’ তথা চেহারা–পরিচয়–ঘরানা দেখে বিচারের ধারা চালু রেখে ‘রুল অফ ল’ বা আইনের শাসনের দাবি করতে পারে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রকৃত অপরাধী খোঁজার পরিবর্তে যদি নির্দিষ্ট পরিচয় বা মতাদর্শকে নিশানা বানায়, তাহলে তা নাগরিক অধিকারের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।”
বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) ইন্তিফাদা বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য ডা. মেহেদী হাসান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে সংগঠনটি এসব কথা জানায়।
বিবৃতিতে বলা হয়, “বিশেষ করে মাওলানা আতাউর রহমান বিক্রমপুরী ও আইনুল হক কাসেমীর আটক ও পরবর্তীতে গ্রেফতার দেখানো নিয়ে আমরা গভীর উদ্বেগ জানাচ্ছি। মাওলানা বিক্রমপুরীকে হাসিনা রেজিমের মত তুলে নিয়ে মুজিবের আমলের বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। ভিন্নমত দমনে এই কালাকানুনের ব্যবহার নতুন বাংলাদেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মাওলানা আইনুল হক কাসেমীর গ্রেফতারও হাসিনা রেজিমের জুলুমকে মনে করিয়ে দেয়। প্রথম আলো–দ্য ডেইলি স্টারের ঘটনার কারণে তাঁকে সাদা পোশাকে এসে, কালো গ্লাসের মাইক্রোবাসে করে রাতে তুলে নেওয়া হয়েছে। অথচ তিনি ঘটনার সময় ‘প্লেইস অফ অকারেন্স’-এ উপস্থিতই ছিলেন না। তাঁর বিরুদ্ধে যদি সরাসরি সহিংসতার অভিযোগ আনা হয়, তবে রাষ্ট্রকে সেটার সুস্পষ্ট প্রমাণ দেখাতে হবে। নিছক অনুমান, সংশ্রব বা সুবিধাবাদের ওপর ভিত্তি করে নির্বিচারে আলেম, মাদরাসা ছাত্র ও ইসলামপন্থী তরুণদের গ্রেফতার বা হয়রানি করা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।”
সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টকে অজুহাত বানিয়ে গ্রেফতারের সমালোচনা করে বিবৃতিতে আরও বলা হয়,
“যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো কথাকে তাকে গ্রেফতারের কারণ হিসেবে দেখানো হয় তাহলে আমরা সেই পোস্ট দেখে নিশ্চিত হয়েই বলছি যে তিনি কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো উসকানি প্রদান করেননি, বরং কেবল ঘটনার একটা ধারা–বিবরণী দিয়েছেন মাত্র। অথচ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের অনেক স্পষ্ট উসকানি বা হামলার ডাক পাবলিক ডোমেইনে বিদ্যমান রয়েছে; অথচ তাদের বিষয়ে রাষ্ট্রের কোনো রকম তৎপরতা দৃশ্যমান নয়।”
আইন প্রয়োগে বৈষম্যমূলক টার্গেটিং প্রসঙ্গে ইন্তিফাদা বাংলাদেশ বলেছে, “আইনের খড়গ নেমে এসেছে কেবল মাদরাসা ছাত্র, আলেম–ওলামা ও সাধারণ মানুষের ওপর। সহজ টার্গেটকে ধরা, প্রভাবশালীদের সঙ্গে সমঝোতা আর দুর্বলদের গ্রেফতার দিয়ে অন্যদের কাছে বার্তা পাঠানোর এই প্রবণতাগুলো প্রমাণ করে যে রাষ্ট্রের চোখে সবাই সমান না। অকাট্য প্রমাণের বদলে, পরিচয়ই এখানে অপরাধের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
কওমি শিক্ষাব্যবস্থাকে সন্দেহের কাঠগড়ায় তোলার অভিযোগ এনে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, “এছাড়া আমরা দেখেছি প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ধৃতদের একজনকে সুনির্দিষ্টভাবে ‘কওমি মাদ্রাসা’র ছাত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, অথচ অন্যদের শিক্ষাগত পরিচয় উহ্য রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থাকে সন্দেহের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে; একটি ইতিমধ্যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকত্বের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।”
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নীরবতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে ইন্তিফাদা বাংলাদেশ। বিবৃতিতে বলা হয়, “এই প্রেক্ষিতে যারা নিজেদেরকে মানবাধিকার ও অন্তর্ভুক্তির চ্যাম্পিয়ন দাবি করেন, তাঁদের নীরবতাও লক্ষণীয়। অধিকার সবার জন্যই প্রযোজ্য হতে হবে। কিছু মানুষের জন্য অধিকার এবং বাকিদের জন্য দমনপীড়নের দ্বৈত মানদণ্ড গ্রহণযোগ্য নয়।”
শহীদ শরীফ উসমান হাদী হত্যা মামলায় অগ্রগতি না থাকা এবং কর্পোরেট মিডিয়ার কেসে বিদ্যুৎগত তৎপরতার বৈপরীত্য তুলে ধরে ইন্তিফাদা বাংলাদেশ বলেছে, “সেই সাথে ১২ দিন হয়ে যাবার পরও শরীফ উসমান হাদীর খুনিদের গ্রেফতারে দেশবাসী এখনো কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখেনি। প্রথম আলো–ডেইলি স্টারের ঘটনায় রাষ্ট্র বিদ্যুৎগতিতে অ্যাকশানে চলে যাচ্ছে, কিন্তু হাদীর খুনিদের বিরুদ্ধে কাজ চলছে কচ্ছপগতিতে; এ অবস্থা বিস্ময়কর।”
কর্পোরেট মিডিয়া ও এলিট ইকোসিস্টেমের ভূমিকা সম্পর্কে সংগঠনটি সতর্ক করে বলেছে, “এই ধারা চলতে থাকলে জনমনে এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হবে যে, কর্পোরেট মিডিয়া ও তাদের এলিট ইকোসিস্টেম শুধু খবর পরিবেশন করে না; বরং তারা এমন এক আধিপত্যবাদী বয়ান উৎপাদন করে, এমন এক কাঠামো নির্মাণ করে ও টিকিয়ে রাখে যেখানে বৈষম্যকে স্বাভাবিক মনে হয়, ইসলামপন্থীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানানো হয়, এবং পরে সেই বৈষম্য রাষ্ট্রীয় আচরণে রূপ নেয়।”











