শনিবার | ২৭ সেপ্টেম্বর | ২০২৫

চালু হচ্ছে সুলতান আব্দুল হামিদ রহ. নির্মিত ঐতিহাসিক হেজাজ রেলপথ

সুলতান আব্দুল হামিদ নির্মিত ঐতিহাসিক হামিদিয়া হেজাজ রেলপথ সচলে সম্মত হয়েছে সিরিয়া, জর্ডান ও তুরস্ক।

তুর্কি সংবাদমাধ্যম ডেইলি সাবাহর এক প্রতিবেদনে একথা জানানো হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ঐতিহাসিক হেজাজ রেলপথ সচলে সম্মত হয়েছে সিরিয়া, জর্ডান ও তুরস্ক। তুর্কি পরিবহন ও অবকাঠামো মন্ত্রী আব্দুল কাদির উরালওগলু সংবাদমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। যা মুসলিম বিশ্বের আঞ্চলিক সংযোগ পুনরুদ্ধার এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণের দিকে একটি বড় পদক্ষেপ।

উরালওগলু বলেন, ঐতিহাসিক হেজাজ রেলপথ পুনরায় সচল হতে যাচ্ছে। এই মাসের শুরুতে আম্মানে সিরিয়া, জর্ডান ও তুরস্কের মাঝে এবিষয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে তিন পক্ষই এব্যাপারে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে।

তিনি আরো বলেন, পরিবহন অবকাঠামোতে ব্যাপক সহযোগিতার রূপরেখা প্রদানকারী একটি খসড়ার সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) উপরও তিন দেশ একটি প্রাথমিক চুক্তিতে পৌঁছে। যার অংশ হিসেবে তুরস্ক সিরিয়া অংশের রেলপথের ৩০ কিলোমিটার (১৮.৬ মাইল) অনুপস্থিত সুপারস্ট্রাকচার সম্পন্ন করতে সহায়তা করবে।

অপরদিকে জর্ডান বাশার পরবর্তী দেশটির অভ্যন্তরে লোকোমোটিভের রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত এবং পরিচালনায় সহায়তা করার জন্য তাদের প্রযুক্তিগত ক্ষমতা মূল্যায়ন করবে।

তিনি আরো বলেন, জর্ডানের আকাবা বন্দরের মাধ্যমে লোহিত সাগরে তুরস্কের প্রবেশাধিকার বিস্তৃত করার লক্ষ্যে তিনটি দেশ যৌথ প্রযুক্তিগত গবেষণা পরিচালনার পরিকল্পনাও করেছে।

গৃহযুদ্ধের ফলে দীর্ঘ ১৩ বছর স্থগিত থাকার সিরিয়া হয়ে পুনরায় সড়কপথে তুরস্ক এবং জর্ডানের মাঝে সরাসরি পরিবহন যোগাযোগ শুরু হতে চলেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা আমাদের অঞ্চলের ঐতিহাসিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিবহন করিডোরেও শক্তিশালী সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করছি। পরিবহন খাতে অংশীদারিত্বমূলক ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে আমরা আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবো।

ইতোপূর্বে ২০২৩ সালের ২২ মার্চ ঐতিহাসিক হামিদিয়া হেজাজ রেলপথ পুনরায় সচলের অংশ হিসেবে তুরস্ক ও ইরাকের মধ্যে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিলো।

চুক্তি সাক্ষর শেষে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, বসরা থেকে তুর্কি সীমান্ত পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ ও স্থলপথে পরিবহন করিডর স্থাপনে তুর্কি সরকারের সাথে কাজ করতে সম্মত হয়েছেন ইরাকি প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শাইয়া আল-সুদানি।

তুরস্ককে আবার আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের সাথে সংযুক্ত করতে এই প্রকল্পটি কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা আশাবাদী।

আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম দেশগুলোও এই প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী। কেননা প্রকল্পটি মানবিক সম্পর্ক জোরদার করার পাশাপাশি তুর্কি-আরব আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং বাণিজ্যের বিকাশ ঘটাতেও সাহায্য করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

ধ্বংসপ্রাপ্ত ও অচল হামিদিয়া হেজাজ রেলপথের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছিলেন, সকল ভ্রাতৃপ্রতিম দেশগুলোর অংশগ্রহণই পারে ‘সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পটিকে’ আমাদের সকলের অঞ্চলের ‘সিল্ক রোডে’ পরিণত করতে।

ঐতিহাসিক হামিদিয়া হেজাজ রেলপথ:

সড়কপথে তুর্কি-আরব সংযোগ স্থাপনে ১৯০০ সালের ১লা মার্চ মুসলিম বিশ্বের তৎকালীন খলিফা আব্দুল হামিদ খান সানী একটি রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন যা শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ১৯০৮ সনে গিয়ে সমাপ্ত হয়। পুরো মুসলিম বিশ্বকে একত্রকারী সেই দীর্ঘ রেলপথের ব্যপ্তি ছিলো ইস্তাম্বুল থেকে দামেস্ক হয়ে মক্কা-মদিনা ও ইয়েমেনের কিছু অংশ পর্যন্ত, সংখ্যায় যার পরিমাপ ১৭৫০ কিলোমিটার।

তবে আফসোসের বিষয় হলো, খলিফা আব্দুল হামিদ সানীর স্বপ্নের প্রজেক্ট ও মিল্লাতে ওয়াহিদার প্রতীক হামিদিয়া হেজাজ রেলওয়ে দুর্ধর্ষ ব্রিটিশ গোয়েন্দা লরেন্সের ষড়যন্ত্রের ফলে বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। স্বয়ং আরবরাই ১৯১৬-১৮ সনে লরেন্স অফ আরাবিয়া খ্যাত সেই কুখ্যাত গোয়েন্দার প্ররোচনায় রেলপথের বিভিন্ন অংশে বোমা হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে দেয়।

জানা যায়, সৌদি অংশে হামিদিয়া হেজাজ রেলপথ অচল থাকলেও দামেস্ক , ফিলিস্তিন ও জর্ডান অংশে স্থানীয়ভাবে এই রেলপথের অবশিষ্টাংশ এখনও সচল রয়েছে।

সামরিক ও প্রশাসনিক কৌশলগত উদ্দেশ্যের পাশাপাশি এই রেলপথ নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্যে ছিলো, হাজ্বিদের হজ্বের সফর সহজ করা। ইউরোপীয়দের হজ্ব কেন্দ্রিক হুমকি মোকাবিলা ও তাদের পরিবহন সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেওয়া।

ঐতিহাসিক হামিদিয়া হেজাজ রেলপথটি শুধু মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রতীক ও ইসলামী খেলাফতের দূরদর্শী মেগা প্রজেক্ট ছিলো না, প্রকৌশলের দিক থেকেও এটি অন্যান্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলো।

পাথরের ভায়াডাক্ট, মরুভূমি স্টেশন এবং কঠোর ভূখণ্ডের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া ন্যারো-গেজ ট্র্যাকের মতো অসম্ভব ইঞ্জিনিয়ারিং কীর্তি একে তৎকালীন যুগে অনন্য করে তুলেছিলো। এছাড়া ঋণে জর্জরিত থাকা সত্ত্বেও এই মেগা প্রজেক্টটি সম্পন্ন করতে ইসলামী খেলাফতকে কোনো ধরণের ঋণ নিতে হয়নি। বরং পুরো মুসলিম বিশ্ব থেকে মুসলিমরা এই প্রজেক্টের জন্য তাদের বিভিন্ন ধরণের সম্পদ দান করে দিয়েছিলো। উসমানী সেনাদের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজন স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়েছিলো।

spot_img
spot_img

এই বিভাগের

spot_img