বুধবার, মার্চ ১২, ২০২৫

সংকটে পাকিস্তানের নারী শিক্ষা; গ্রেফতারের পাশাপাশি ভাঙ্গা হলো নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামেয়া হাফসা

গ্রেফতার ও ভবন ভেঙে ফেলার মধ্যদিয়ে নারী শিক্ষায় নতুন করে সংকট সৃষ্টি করলো পুতুল সরকার খ্যাত পাকিস্তানের শাহবাজ সরকার।

মঙ্গলবার (৫ মার্চ) ইসলামাবাদের ঐতিহাসিক লাল মসজিদের নারী শিক্ষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামেয়া হাফসার আংশিক ভেঙে দেয় পাক প্রশাসন।

ইসলামাবাদ প্রশাসন ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ দাবী করে, নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামেয়া হাফসার আংশিক অবৈধভাবে নির্মিত হওয়ায় তা ভেঙে ফেলা হয়েছে।

তবে সরকারের এক উর্ধ্বতন কর্মকতা সংবাদমাধ্যমকে জানান, স্বররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশে প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামোর আংশিক ভেঙে দেওয়া হয়েছে। যেনো এর প্রভাবশালী ধর্মীয় কর্তৃপক্ষকে সরকারের সাথে আলোচনায় বসানো যায় এবং আপোষে বাধ্য করা যায়।

এছাড়া অভিযানের প্রকৃত তথ্য ও অন্যায্য কার্যকলাপ যেনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারিত হতে না পারে, তাই বিশ্ববিদ্যালয় মর্যাদার ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেইজও সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দেয় সরকার।

অবকাঠামো ভেঙে ফেলার পর জামেয়া হাফাসার কর্তৃপক্ষ বিবেচিত ঐতিহাসিক লাল মসজিদের খতিব মাওলানা আব্দুল আজিজ এক বিবৃতিতে জানান, সরকার তার নীতি ও শর্ত ভঙ্গ করেছে। জামেয়া হাফসার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, সরকার শুরু থেকেই ইসলামাবাদ থেকে জামেয়া হাফসা সরিয়ে নেওয়ার ফন্দি করছিলো। ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে প্রশাসনের কর্মকর্তারাও নিয়মিত জামেয়ায় আসছিলেন। ইসলামাবাদের মারগালা টাউনে মাদানি মসজিদের পাশে দেড় কাঠার একটি প্লটও বরাদ্দ দিয়েছিলো, যা প্রতিষ্ঠানের জন্য পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু ইসলামাবাদ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সিডিএ সেই একই জায়গা সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ দিয়ে নির্মাণ কাজ শুরু করে দেয়। অথচ সরকারের সাথে জামেয়া হাফসা নিয়ে তখনো আলোচনা চলমান। বরাদ্দকৃত প্লটে যে সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজ চলমান তা তাদের জানানো হয়নি।

হাফসা প্রধান উম্মে হাসান বিষয়টি সুরাহার লক্ষ্যে নির্মাণ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের সাথে আলোচনার জন্য গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বুধবার রাতে ঘটনাস্থলে গেলে এক পর্যায়ে তাকে সহ শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার করা হয়। শিক্ষার্থী ও মাদানি মসজিদ কর্তৃপক্ষের ১জন সহ সর্বমোট ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

ঐতিহাসিক লাল মসজিদের খতিব জানান, তার স্ত্রী ও জামেয়া হাফসার প্রধান উম্মে হাসানকে গ্রেফতারের ঘটনায় শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজন যখন ক্ষেপে উঠে এবং সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তখন এটি ভেঙে ফেলার বিপরীতে তার মুক্তির প্রস্তাব রাখে সরকার প্রশাসন। কিন্তু কঠোরভাবে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়। এছাড়া সংস্কৃতি ও বিনোদনের নামে অনৈতিক ও অশ্লীল অনুষ্ঠান ও কার্যকলাপ রোধে লাল মসজিদের অধীন জামেয়াগুলো যে সামাজিক ও নৈতিক তৎপরতা চালায় তা বন্ধেরও শর্তারোপ করে।

ইসলামাবাদ প্রশাসন জানায়, নির্মাণ কাজে বাঁধা দিতে প্রশাসনের উপর হামলা, গুলি চালানো ও দু’জনকে সাময়িক জিম্মি করে রাখার অপরাধে জামেয়া হাফসার প্রধান উম্মে হাসান, মাদানি মসজিদ কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার করা হয়েছে।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার আদালতে তাদের ৪দিনের শারীরিক রিমান্ডও মঞ্জুর করে প্রশাসন। উম্মে হাসানকে গ্রেফতারের পর থেকে এমনিতেই লাল মসজিদ সহ ইসলামাবাদের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের বিক্ষোভ ও অবরোধে উত্তাল ছিলো। রিমান্ড মঞ্জুরের পর পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠে। পুরো লাল মসজিদ এলাকায় ১৫০ এর অধিক পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। পুরো এলাকার প্রবেশ পথ কাঁটাতার ও ব্যারিকেড দিয়ে অবরুদ্ধ করে দেওয়া হয়। বিক্ষোভ ও অবরোধকারী নারী শিক্ষার্থীদেরও গ্রেফতারের বারংবার চেষ্টা চালানো হয়। কিছু কিছু জায়গায় নারী শিক্ষার্থীদের আঘাত করে রক্তাক্তও করা হয়, মোবাইলে ধারণ করা যার ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি একাউন্ট থেকে প্রকাশিত হয়।

এছাড়া আরেকটি ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয়। যেখানে দেখা যায়, পুলিশ যখন বারংবার শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার চেষ্টা চালাচ্ছিলো, জামেয়া হাফসার কর্তৃপক্ষ ও ঐতিহাসিক লাল মসজিদের খতিব মাওলানা আব্দুল আজিজ কাঁটাতারের ভেতরে থেকে রাইফেল হাতে পুলিশদের ধমক দিচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, যদি তোমরা ভেতরে আসো তবে তোমাদের এটা (রাইফেল) দিয়ে জবাব দিবো ইনশাআল্লাহ। আমাকে মেরে ফেললে মেরে ফেলতে পারো কিন্তু আমার ছেলে ও মেয়ে সন্তানেরা (শিক্ষার্থী) তোমাদের এমন হাশর (পরিণতি) করবে তোমরা আজীবন মনে রাখবে। করো তোমরা যেমন জুলুম করতে চাও, কিন্তু তোমাদের হাশর (পরিণতি) হবে সেটাই।

জামেয়া প্রধান উম্মে হাসান ও শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার এবং অবকাঠামো ভাঙ্গার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেয় পাকিস্তানের অন্যতম প্রভাবশালী সংগঠন জামায়াতে আহলে সুন্নাত। তারা সরকারকে অতিদ্রুত উম্মে হাসান ও শিক্ষার্থীদের মুক্তি, জামেয়ার পুনর্নির্মাণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের আহবান জানান। লাল মসজিদ ট্রাজেডির পুনরাবৃত্তি করা থেকে সতর্ক করে। জঙ্গি জুজুর নাটক তৈরি থেকে বিরত থাকার আহবান জানান।

জামেয়া হাফসা নিয়ে সরকারের মূল বিরোধ যেখানে:

২০০৭ সালে অবরোধ করে ঐতিহাসিক লাল মসজিদে হামলা চালানোর মধ্যদিয়ে এক কালো অধ্যায় রচনা করে জাতীয় গাদ্দার উপাধি পাওয়া পাকিস্তানের পারভেজ মোশাররফের সরকার।

তার নির্দেশে প্রায় ৪০০ রক্ষণশীল আলেম ও মুসলিম নারী-পুরুষকে জঙ্গি দাবীতে হত্যা করে দেশটির সেনারা। ভেঙে ফেলা হয় কিং ফয়সাল মসজিদের আগ পর্যন্ত পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ও অন্যতম প্রাচীন ঐতিহাসিক মসজিদ, যা উসমানীয় ও মুঘল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি করা হয়েছিলো।

সেনাবাহিনীর এমন নৃশংস হামলায় শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজনের পাল্টা প্রতিরোধে ডজন খানেক সেনা সদস্যও নিহত হয়েছিলো।

পাকিস্তানে নারীদের সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামেয়া হাফসা এই লাল মসজিদেরই অংশ। মসজিদের সাথে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিও ভেঙে ফেলে পারভেজ মোশাররফের বাহিনী।

মসজিদের পাশাপাশি ২০২২ সালে জামেয়া হাফসার পুনর্গঠন হয়। ফেডারেল সরকার ও সিডিএর প্রতি ২০০৭ সালে সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ থাকলেও সরকার ১ বছরের মধ্যে তা তার স্ব-স্থানে পুনর্গঠন বা পুনর্নির্মাণ করে দেয়নি।

২০১১ সালে তৎকালীন স্বররাষ্ট্র মন্ত্রী রেহমান মালিক এবং বাহরিয়া টাউনের মালিক ও রিয়েল স্টেট কিং মালিক রিয়াজ জামেয়া কর্তৃপক্ষকে তার মূল স্থানের বিকল্প হিসেবে ইসলামাবাদের সেক্টর এইচ-এ ২০ কানাল জমি দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও তখন তা দেওয়া হয়নি। উল্টো মসজিদ ও জামেয়া কর্তৃপক্ষ নিজেরাই নির্মাণ কাজ শুরু করলে ২০১৯ সালে তা জোরপূর্বক বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। অথচ তখন এর বেসমেন্ট সহ ভবনের মূল কাজ সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিলো। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পরেও যখন বিকল্প জমি প্রদান ও নির্মাণের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি তখন মসজিদ ও জামেয়া কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে নিজ উদ্যোগে মূল জায়গাতেই ২০২২ সালে এর পুনর্গঠনের কাজ সম্পন্ন করে।

সম্প্রতি ফেব্রুয়ারিতে নতুন করে জামেয়া হাফসা নিয়ে তৎপর হয়ে উঠে প্রশাসন। আলোচনার জন্য জামেয়ায় যাতায়াত শুরু করে। বিকল্প স্থান হিসেবে মারগালা টাউনে মাদানি মসজিদের পাশে দেড় কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ দেয়, যা জামেয়া হাফসার জন্য খুবই ছোট ও অপর্যাপ্ত। যেখানে আবার অপর একটি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজ করছিলো প্রশাসন। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বুধবার এবিষয়ে অবগত হয় জামেয়া কর্তৃপক্ষ। যার সুরাহা করতে গিয়ে গ্রেফতার হোন জামেয়া প্রধান উম্মে হাসান। অথচ সরকারের দাবী অনুযায়ী জামেয়াটি বিকল্প স্থানে সরিয়ে নিতে আলোচনা তখনও চলমান ছিলো এবং মারগালা টাউনে জামেয়ার নামে যে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাতে যে সিডিএ অপর একটি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজ করছে সে বিষয়ে কোনোভাবেই অবগত করা হয়নি। মঙ্গলবার (৫ মার্চ) যে জামেয়া হাফসা ভাঙা হলো এর জন্যও পূর্ব কোনো নোটিশ দেওয়া হয়নি। শুধু ফেব্রুয়ারিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছিলো যে, নিরাপত্তা বিবেচনায় জামেয়া হাফসা তার মূল স্থান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।

সরকার ও প্রশাসনের জঙ্গি জুজু তৈরি ও নিরাপত্তার নামে অযৌক্তিক ও অন্যায্য সিদ্ধান্তে লাল মসজিদ এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজন উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সর্বোচ্চ আদালতের ২০০৭ সালের চূড়ান্ত আদেশ বহাল থাকা সত্ত্বেও তারা জামেয়ার অবকাঠামো আংশিক ভেঙে দেয়, ব্যবহারের উপযুক্ত না হওয়ায় যা একেবারে পুরোটাই ভেঙে ফেলার নামান্তর।

সূত্র: ডন নিউজ, হাম

spot_imgspot_img

সর্বশেষ

spot_img
spot_img
spot_img
spot_img