আজ ৫ আগস্ট। এক বছর আগে এই দিনে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটে, ভারতীয় আধিপত্যবাদের পতন হয়। ছাত্র-জনতার দুর্বার গণআন্দোলনের মুখে পড়ে শেখ হাসিনা দেশ থেকে ভারতে পালাতে বাধ্য হন।
এই দিনটি কেবল একজন স্বৈরশাসকের প্রস্থান নয়, বরং এটি একটি নির্যাতনমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, একদলীয় দখলদারি প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের বিজয়ের দিন।
আজকের দিনটি সরকারিভাবে উদযাপন করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ উপলক্ষে ঘোষণা করা হয়েছে সরকারি ছুটি। রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে বাণী দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা আজ জাতির সামনে তুলে ধরবেন ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’, যেখানে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রগঠনের দিকনির্দেশনা থাকবে। একইসাথে রাজধানী ও জেলা শহরগুলোতে রাস্তাজুড়ে চলছে বর্ণাঢ্য র্যালি, ছাত্রসমাবেশ ও সাংস্কৃতিক আয়োজন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছিল সেই মহেন্দ্রক্ষণ, যেদিন দীর্ঘ প্রতিরোধের পরিণতিতে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এমন বিদায় কদাচিৎ ঘটে। আর এমন আন্দোলনও বিরল, যেখানে সংগঠকহীন, বিকেন্দ্রীভিত্তিক ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ একদিন রাষ্ট্রযন্ত্রকে হার মানাতে বাধ্য করে।
জনতার এ বিজয়ের সূচনা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, কোটা সংস্কারের দাবিতে। ১ জুলাইয়ের সেই প্রতিবাদ, ৩৬ দিনের পথ পেরিয়ে রক্তে-ঘামে এক গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
২০০৮ সালের সেনাসমর্থিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা দেশে এক ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র কায়েম করেন। ভোটারবিহীন নির্বাচন, বিরোধী দল দমন, গুম, হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচার বিভাগের দলীয়করণ, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ, সবকিছুই ছিল তার শাসনের বৈশিষ্ট্য।
‘গণতন্ত্রের মা’ নামে পরিচিত হবার চেষ্টায় থাকা হাসিনাই ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে নির্লজ্জভাবে এক ব্যক্তিশাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এক ঐতিহাসিক প্রতিরোধ। দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে এই দাবি। শেখ হাসিনা এই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং ১৪ জুলাই কটাক্ষ করে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ আখ্যা দেন।
এই অপমানজনক মন্তব্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। ছাত্ররা তখন আর শুধু কোটা নয়, বরং ফ্যাসিবাদ পতনের শপথ নেয়।
১৬ জুলাই, রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। একই দিনে চট্টগ্রামে নিহত হন ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরামসহ ৬ জন। এটি ছিল একটি মোড় পরিবর্তনের মুহূর্ত। আন্দোলন হয়ে যায় সশস্ত্র পুলিশের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক গণপ্রতিরোধ।
শুধু ছাত্ররাই নয়, এই আন্দোলনে নামেন শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, অভিভাবকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, সব ক্যাম্পাসে একই চিত্র। সরকার আইচএসসি পরীক্ষার্থীদের পর্যন্ত গ্রেফতার করে, ক্যাম্পাসে গুলি চালায়, ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর চালায় নির্যাতন।
এই সময় শেখ হাসিনা আন্দোলন দমনে ব্যবহার করেন গোয়েন্দা সংস্থা, প্রশাসন এবং দলীয় ক্যাডারদের।
সমন্বয়কারীদের ছয়জন, নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, নুসরাত তাবাসসুম, আবু বাকের মজুমদার, তুলে নিয়ে জোর করে বার্তা প্রচার করানো হয়।
কিন্তু গণআন্দোলন থামেনি। বরং সেখান থেকে আসে ঐতিহাসিক ঘোষণা, “এক দফা: শেখ হাসিনার পদত্যাগ”।
সরকার ৫ আগস্ট সকাল থেকে ঢাকায় কারফিউ জারি করে। মোবাইলে পাঠানো হয় হুমকির বার্তা। ঘোষণা দেওয়া হয়, রাজপথে নামা মানে মৃত্যুকে ডাক দেওয়া। কিন্তু কারফিউ টেকেনি।
গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, বাড্ডা, শাহবাগ, রামপুরা, সর্বত্র হাজার হাজার মানুষ জড়ো হতে শুরু করে। পুলিশ বাধা দেয়, গুলি চালায়, তবুও মানুষ থামেনি। সেই মুহূর্তে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে খবর, শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়েছেন।
হাসিনার দেশত্যাগের খবর আসতেই ঢাকার বাতাস পাল্টে যায়। উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা। ঢাকার রাজপথে নেমে আসে লাখ লাখ মানুষ। মিছিল, স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে নগরী। গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে জনতা। কেউ নিচ্ছেন টিভি, কেউ হাঁস-মুরগি, কেউ রুই মাছ। কেউ নেমেছেন গণভবনের লেকে গোসল করতে। এক বিজয়ের উচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে গোটা দেশ।
শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশের শহর-উপশহর, ইউনিয়ন-গ্রামে বিজয় মিছিল, আনন্দ মিছিল, মিষ্টি বিতরণ হয়। দীর্ঘ এক দুঃশাসনের পতনে বাংলাদেশ উল্লাসে ভেসে যায়।
৫ আগস্ট দুপুরে সেনাবাহিনীর তথ্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। মানুষ তখনই বুঝে যায়, পরিবর্তন আসন্ন।
বেলা পৌনে ৪টায়, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেনাসদরে দাঁড়িয়ে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। দেশের নিয়ন্ত্রণ এখন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে হস্তান্তর করা হচ্ছে।”
তিনি জনগণকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান এবং বলেন, দেশের সকল নাগরিকের অংশগ্রহণে একটি নতুন পথচলা শুরু হবে।
এই ঘোষণায় পুরো জাতি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। ১৫ বছরের গুম-খুন-ভয়ের শাসন শেষ হয়েছে, এই বার্তাই ছিল সেনাবাহিনীর মুখে শেষ সত্য উচ্চারণ।
সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের আহ্বানে বঙ্গভবনে বসে দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের বৈঠক।
উপস্থিত ছিলেন, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রধান, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামি, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, ছাত্রদের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি
বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় পাঁচটি সিদ্ধান্ত: জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে, খালেদা জিয়া ও সব রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে, নিরাপদ পরিবেশে অবাধ নির্বাচনের আয়োজন করা হবে ও কোটা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে শোক প্রস্তাব পাস হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দায়িত্ব দেওয়া হোক।
সবার সম্মতিতে ৭ আগস্ট ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মনোনীত হন এবং ৮ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন।
হাসিনার পতন বিশ্বমিডিয়ায় দারুণ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
জাতিসংঘ বিবৃতি দিয়ে জানায়, “বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক উত্তরণে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত অতিক্রম করল।”
তুরস্ক বলেছে, “জনগণই রাষ্ট্রের মালিক—বাংলাদেশ প্রমাণ করল।”
ওআইসি, মালয়েশিয়া, ইরান, কাতার, পাকিস্তান—সবাই অভিনন্দন জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারকে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং ব্রিটেন উদ্বেগের কথা জানালেও বলে, “গণতান্ত্রিক রূপান্তরের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা ধরে রাখতে হবে।”
বিশ্ব মিডিয়ায় “Bangladesh’s People’s Revolution”, “Fall of the Last South Asian Autocrat”, “Generation Z vs Hasina” এই ধরনের হেডলাইন ছড়িয়ে পড়ে।
আন্দোলনের সময় শহীদ হন অন্তত ১৪০০ জন, যাদের অনেকেই অজ্ঞাত থেকে যান। জাতিসংঘের ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশন, এসিএলইডি, বিবিসি, সবাই নিশ্চিত করে এই পরিসংখ্যান সত্য।
সরকারি হিসাবে ৮৩৪ জন নিহত এবং ১৮০০০+ আহত। হাসিনার পুলিশ বাহিনী শিশু, মহিলা, সাংবাদিক কাউকেই ছাড় দেয়নি। যাত্রাবাড়ী, রাজারবাগ, মোহাম্মদপুরে নিহত হন নিরস্ত্র নারী ও বৃদ্ধরা।
এই আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে ঘোষিত হয়, ৫ আগস্ট শহীদ দিবস।
এই দিনটি শুধু শেখ হাসিনার পতনের দিন নয়, এটি নতুন বাংলাদেশের সূচনা। একটি ভীতিকর, অবিচারপূর্ণ, স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিজয়ের দিন। আজকের তরুণরা ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৯০ এর গৌরবগাথা নিয়ে কথা বলে না শুধু—তারা নিজেরাই লিখেছে এক নতুন অধ্যায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট।
আর ৫ আগস্ট থাকবে, বাংলাদেশের জনগণের আত্মত্যাগ, সাহসিকতা ও বিজয়ের চিরন্তন প্রতীক হিসেবে।









