বুধবার | ২০ আগস্ট | ২০২৫

আল্লামা বাবুনগরী রহ. : চীর আপোষহীন মুসলিম রাহবার

বাংলাদেশের ইসলামি আন্দোলনের ইতিহাসে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন, যাঁদের নাম উচ্চারণের সাথে সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং আন্দোলনের স্মৃতি জেগে ওঠে। তাঁদের একজন হলেন আল্লামা হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরী রহ.,যিনি শুধু একজন আলেমে দ্বীন নন, বরং ছিলেন এক আপোষহীন রাহবার, এক মজলুম ধর্মীয় নেতা, যিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইসলাম ও মুসলমানদের অধিকার রক্ষায় আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন।

২০২১ সালের ১৯ আগস্ট, চট্টগ্রামের সিএসসিআর হাসপাতালে দুপুর সাড়ে ১২টার সময় যখন তাঁর ইন্তেকালের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে, তখন গোটা দেশ শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে মসজিদ, মাদ্রাসা ও সর্বত্র নেমে আসে শোকের ছায়া। লাখো মানুষ হাটহাজারীর পথে ছুটে যায় তাঁর শেষ জানাজায় শরিক হতে। সেই দৃশ্য ছিল উপমহাদেশের আলেমদের মর্যাদা ও জনগণের ভালোবাসার এক ঐতিহাসিক প্রমাণ।

তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় ছিল সংগ্রামমুখর। তিনি ছিলেন এমন এক নেতা, যিনি জালিম সরকার, কোনো শক্তি বা কোনো প্রলোভনের কাছে মাথা নত করেননি। কখনো জেল, কখনো রিমান্ড, কখনো শারীরিক নির্যাতন—কোনো কিছুর ভয় তাঁকে দমাতে পারেনি। তাঁর আপোষহীন কণ্ঠস্বর সবসময় বাতিলের বিরুদ্ধে ধ্বনিত হয়েছে। এজন্য তাঁকে দেওয়া হয়েছে “কায়েদে মিল্লাত” ও “আপোষহীন সিপাহসালার” উপাধি।

আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী রহ. ছিলেন একাধারে একজন বড় মুহাদ্দিস, গবেষক, লেখক, সংগঠক, মিডিয়া অভিভাবক এবং রাজপথের অকুতোভয় সিপাহসালার। তিনি যেমন হাদিসের মসনদে ছিলেন জাদরেল মুহাদ্দিস, তেমনি শাপলা চত্বরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের রাতে আহত অবস্থায়ও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন দৃঢ়চিত্ত নেতা। ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি সংগ্রামে তিনি ছিলেন অগ্রভাগে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রক্ষা থেকে শুরু করে ভাস্কর্য বিরোধি আন্দোলন ও শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন পর্যন্ত।

তাঁর এই জীবনগাথা শুধু একটি ব্যক্তির গল্প নয়, বরং বাংলাদেশের ইসলামি আন্দোলন ও দ্বীনি শিক্ষা অঙ্গনের এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। তিনি ছিলেন এমন এক দৃষ্টান্ত, যিনি জ্ঞান, ত্যাগ, সাহস ও সত্যনিষ্ঠতার সমন্বয়ে এক বিরল আলেমের রূপে পরিচিতি পেয়েছেন। মৃত্যুর পরও তিনি কোটি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন।

জন্ম ও পরিবার


আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী ১৯৫৩ সালের ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার বাবুনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাওলানা আবুল হাসান রহ. ছিলেন হাটহাজারী মাদরাসার সিনিয়র উস্তাদ ও মুহাদ্দিস এবং প্রখ্যাত গ্রন্থ তানযীমুল আশতাত এর রচয়িতা। এই গ্রন্থ মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যা হিসেবে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত।

মাতা ফাতেমা খাতুন রহ. ছিলেন বাবুনগর মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা হারুন বাবুনগরীর কন্যা এবং হাটহাজারী মাদরাসার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সুফি আজিজুর রহমান রহ.-এর নাতনি। বর্তমান হেফাজতের আমীর আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী তাঁর আপন মামা।

শৈশব ও প্রাথমিক শিক্ষা


শিক্ষার সূচনা হয় মায়ের কাছে। পাঁচ বছর বয়সে ভর্তি হন আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগর মাদরাসায়। সেখানে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা ও কুরআন হিফজ সম্পন্ন করেন। হেফজ শেষে আল্লামা আজহারুল ইসলাম ধর্মপুরী রহ.-এর কাছে শবিনা পাঠে পুরো কুরআন মুখস্থ শোনান।

হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষা


পরে ভর্তি হন দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে। সেখানে আট বছর অধ্যয়ন শেষে ১৯৭৬ সালে দাওরায়ে হাদিসে প্রথম স্থান অর্জন করেন। তাঁর উস্তাদদের মধ্যে ছিলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ., মুফতি আহমদুল হক রহ., আল্লামা আবদুল আজিজ রহ. এবং পিতা আবুল হাসান রহ.। শৈশব থেকেই তাঁর মেধা, কৃতিত্ব ও অধ্যবসায় তাঁকে সবার কাছে বিশেষ করে তুলেছিল।

পাকিস্তানে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা


১৯৭৬ সালে তিনি পাকিস্তানের করাচিতে বিশ্ববিখ্যাত জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়া বিন্নুরী টাউনে ভর্তি হন। আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী রহ.-এর তত্ত্বাবধানে তিনি হাদিস শাস্ত্রের গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। সেখানে তিনি উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগ থেকে সিরাতুল ইমামিদ দারিমি ও তাঁর শায়খগণের পরিচিতি শীর্ষক একটি আরবি গবেষণাপত্র রচনা করেন। এ গবেষণায় তিনি হাদিসশাস্ত্র ও ইলমে রিজালের ওপর যুগোপযোগী আলোচনা উপস্থাপন করেন, যা তাঁকে সর্বোচ্চ সনদ এনে দেয়।

শিক্ষকতা জীবন


১৯৭৮ সালে দেশে ফিরে বাবুনগর মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। টানা ২৪ বছর তিনি সেখানে শিক্ষকতা করেন এবং উলুমুল হাদিস বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ২০০৩ সালে হাটহাজারী মাদরাসায় যোগ দেন। সেখানে মুসলিম শরীফ, তিরমিজি শরীফসহ বড় বড় হাদিসগ্রন্থ পড়াতেন। ধীরে ধীরে তিনি শায়খুল হাদিস ও শিক্ষা পরিচালকের দায়িত্ব পান।

লেখালেখি ও গ্রন্থ রচনা


আল্লামা বাবুনগরী প্রায় দুই ডজন গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, সিরাতুল ইমামিদ দারিমি, তালিমুল ইসলাম, ইসলামিক সায়েন্স, রচনাসমগ্র প্রভৃতি। তিনি বাংলা, আরবি ও উর্দু ভাষায় লেখালেখি করেছেন। তাঁর অনেক গবেষণামূলক প্রবন্ধ আরবি ও উর্দু জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব


২০১০ সালে হেফাজত প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি যুগ্ম মহাসচিব হন। ২০১১ সালে মহাসচিব নির্বাচিত হন এবং টানা ৯ বছর দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রক্ষায় আন্দোলন, শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলন, থেমিস মূর্তি বিরোধী আন্দোলনসহ প্রায় সব ইসলামপন্থী আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে নেতৃত্ব দেন।

২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচিতে তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন। যৌথ বাহিনীর হামলায় আহত হয়ে ৭ মে গ্রেফতার হন। রিমান্ডে তাঁকে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। তিনি পরবর্তীতে বলেন, তাঁকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল।

শাপলার পর যখন এক শ্রেণীর নেতা সরকারের সাথে আপোষের পথে যায়, তিনি তখন ব্যতিক্রম। তিনি সরাসরি আওয়ামী সরকারকে দায়ী করেন এবং মুসলিম জনগণকে মিথ্যা প্রচারণা থেকে সতর্ক থাকতে বলেন।

শাইখুল ইসলাম শাহ আহমদ শফী রহ.-এর ইন্তেকালের পর ২০২০ সালে তিনি হেফাজতের আমীর নির্বাচিত হন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে বহাল ছিলেন।

মিডিয়ায় অবদান


২০১৪ সালে ইসলামী ধারার প্রথম অনলাইন পত্রিকা ইনসাফ আত্মপ্রকাশ করলে তিনি চেয়ারম্যান হন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে বহাল ছিলেন। ইনসাফের মাধ্যমে তিনি ইসলামী সাংবাদিকতার নতুন ধারা প্রতিষ্ঠা করেন।

চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব


আল্লামা বাবুনগরী ছিলেন একাধারে ইলমী আলেম, মুজাহিদ নেতা এবং আপোষহীন রাহবার। তিনি হাদিসশাস্ত্রের একজন জাদরেল মুহাদ্দিস ছিলেন, আবার রাজপথে ছিলেন নির্ভীক কণ্ঠস্বর। তিনি কখনো লোভ, ভয় কিংবা স্বার্থান্বেষী আপোষে রাজি হননি। তাঁর সততা, স্পষ্টবাদিতা ও ত্যাগ স্বীকার এমনকি বিরোধীরাও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।

ইন্তেকাল ও জানাজা


২০২১ সালের ১৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রামের সিএসসিআর হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে হাটহাজারী, চট্টগ্রামসহ সমগ্র দেশ থেকে লাখো মানুষ তাঁর জানাজায় ছুটে আসে। জানাজা জনসমুদ্রে রূপ নেয়। তাঁকে হাটহাজারী মাদরাসার কবরস্থানে দাফন করা হয়।

উপসংহার


আল্লামা হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরী রহ. ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম বরেণ্য আলেমে দ্বীন, যিনি ইলম, আমল, সততা ও আপোষহীনতায় ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি যেমন হাদিসের মসনদে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি রাজপথে থেকেও বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়েছেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় মুসলিম সমাজের জন্য দিকনির্দেশনা।

আজ তাঁর ইন্তেকালের বছর পার হলেও জাতি এখনও তাঁর শূন্যতা অনুভব করে। তিনি রেখে গেছেন হাজার হাজার ছাত্র, অসংখ্য গ্রন্থ, আন্দোলনের উত্তরাধিকার এবং এক আপোষহীন ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া আজও জরুরি, ইলমে দৃঢ় থাকা, সত্যে অবিচল থাকা এবং ইসলামি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় আপোষহীনভাবে এগিয়ে যাওয়া।

spot_img

সর্বশেষ

কেউ যদি এই গণঅভ্যুত্থানের একক কৃতিত্ব নিতে চায়, সেটিও ফ্যাসিবাদেরই বহিঃপ্রকাশ : জমিয়ত মহাসচিব 

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে আমরা স্পষ্ট দেখতে...

সংবিধান কিংবা লিখিত বিধি-বিধান দিয়ে ফ্যাসিবাদ ঠেকানো যায় না: তারেক রহমান

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, সংবিধান কিংবা লিখিত বিধি-বিধান দিয়ে ফ্যাসিবাদ ঠেকানো যায় না। রাষ্ট্র এবং রাজনীতিতে যদি...

মাইলস্টোন বিমান দুর্ঘটনায় আহতদেরকে সহায়তায় ব্রিটিশ চিকিৎসক দলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ প্রধান উপদেষ্টার

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে সংঘটিত বিমান দুর্ঘটনায় গুরুতর আহতদের চিকিৎসায় দ্রুত সহায়তা দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ চিকিৎসক দলের প্রতি...
spot_img

এই বিভাগের

spot_imgspot_img