বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রে “রাষ্ট্রক্ষমতা ও সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর” উল্লেখ থাকায় গণতন্ত্রের মূলনীতির পরিপন্থী দাবি করে দলটির নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেছিল হাইকোর্ট। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল, এমন ঘোষণা জনগণের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে, যা সংবিধানবিরোধী।
২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে নিবন্ধন পাওয়া দলটির বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে কয়েকজন আওয়ামীপন্থী আলেম রিট দায়ের করেন। এরপর ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট এক রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে।
যা বলেছিলেন বিচারকরা

২০১৩ সালের হাইকোর্টের রায়ে জামায়াতের গঠনতন্ত্রের চারটি ধারা বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়।
প্রথমত, গঠনতন্ত্রের ২(৫) ধারায় বলা হয়, “রাষ্ট্রক্ষমতা ও সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর।” হাইকোর্টের মতে, এটি সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী, যেখানে বলা হয়েছে, “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।”
এই প্রসঙ্গে বিচারপতি মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, “গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতার উৎস জনগণ। সেখানে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ঘোষণা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে অস্বীকার করে।”
দ্বিতীয়ত, দলের গঠনতন্ত্রে কেবল মুসলিম পুরুষদের সদস্যপদ ও নেতৃত্বে সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আদালতের মতে, এটি সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন, যা সকল নাগরিকের সমতা ও বৈষম্যহীনতার নিশ্চয়তা দেয়।
বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বলেন, “নারী ও অমুসলিমদের সদস্যপদ ও নেতৃত্ব থেকে বাদ দেওয়া স্পষ্টত বৈষম্যমূলক ও সংবিধানবিরোধী।”
তৃতীয়ত, গঠনতন্ত্রে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভীষ্ট ঘোষণা সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির পরিপন্থী বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।
বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক বলেন, “রাষ্ট্রীয় শাসনে ধর্মকে মুখ্য করতে চাওয়া রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক এবং সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ।”
চতুর্থত, হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে জানানো হয়, দলটি নিবন্ধনের সময় নির্বাচন কমিশনের কাছে যে গঠনতন্ত্র জমা দেয়, তা Representation of the People Order (RPO), ২০০৮-এর ৯০বি ও ৯০সি ধারার শর্ত পূরণ করে না। ফলে নিবন্ধনের আইনগত ভিত্তি ছিল দুর্বল।
রিট আবেদনকারীরা কারা ছিলেন?
২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন ২৫ জন আওয়ামীপন্থী নামধারী আলেম। তাদের মধ্যে ছিলেন, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব মাওলানা সৈয়দ রেজাউল হক চানপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুনশি আব্দুল লতিফ এবং সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি মাওলানা জিয়াউল হাসান।
তারা অভিযোগ করেন, জামায়াতের গঠনতন্ত্র গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও নাগরিক সমঅধিকারের পরিপন্থী।
নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত ও আপিল বিভাগের রায়
২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর হাইকোর্টের রায়ের ভিত্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। পরে দলটি আপিল বিভাগে আবেদন করে।
আজ (১ জুন) আপিল বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পুনর্বহালের নির্দেশ দেয়। নির্বাচন কমিশনকে এই সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকর করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।









