শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ খরার কবলে পড়েছে ইরাক। কমে যাচ্ছে দজলা ও ফুরাতের পানি।
মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে একথা জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তীব্র পানি সংকট ও শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ খরার কবলে পড়েছে ইরাক। ১৯৩৩ সাল পরবর্তী সময়ে দেশটি তার সবচেয়ে শুষ্ক বছর পার করছে।
টাইগ্রিস (দজলা) ও ইউফ্রেটিস (ফুরাত) নদী যা পশ্চিম এশিয়া থেকে পারস্য উপসাগরে প্রবাহিত হয়, এর পানির স্তর ২৭ শতাংশ পর্যন্ত কমে গিয়েছে বলে জানানো হয়। উজানের দিকের বাঁধের ফলে স্বভাবতই পানি কম থাকার পাশাপাশি স্বল্প বৃষ্টিপাত এর প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে খরা এবং পানির ঘাটতির কারণে সৃষ্ট মানবিক সংকটের প্রভাব বসরার মতো প্রাচীন গুরুত্বপূর্ণ বন্দর এবং তেল কেন্দ্রে গিয়ে পড়ছে, যেখানে প্রায় ৩৫ লক্ষ লোকের বসবাস।
সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, বসরা এখনও ইরাকের সবচেয়ে জল-দুর্ভিক্ষপূর্ণ এবং জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। অপর্যাপ্ত জল ব্যবস্থাপনার কারণে শহরটি এখনো গভীরভাবে প্রভাবিত। এর বাসিন্দাদের অনেকেই স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন পানি সরবরাহের জন্য বাধ্য হয়।
হাসান রায়কান নামের এক বসরার বাসিন্দা জানান, শুধু নিজের ভাগের বিশুদ্ধ পানির জন্যই তাকে প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার দূরে সফর করতে হয়, বরং তিনি বাধ্য হোন। পানির জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ তার পরিবারের চাহিদা মেটাতে পারে না।
তিনি বলেন, আমাকে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয়। কাজ ছেড়ে বাড়িতে পানি আনার জন্য চলে যেতে হয় এবং দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
ব্যবহারের পানিও সংগ্রহ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের বাড়ির কাছের সমুদের পানি দূষিত হয়ে গিয়েছে। তা ব্যবহারে চর্মরোগও দেখা দেয়। তাই, গবাদি পশু এবং গৃহস্থালির ব্যবহারের জন্যও পানি সংগ্রহ করতে হয়। তা ব্যবহারের অনুপাত নির্ধারণ করতে হয়। পরিবারের সবাইকে কঠোরভাবে সেই অনুপাত মেনে চলতে হয়।
সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, সমুদ্রের পানির গুণমান আগ থেকেই ব্যবহারের অনুপযুক্ত ছিলো। পয়ঃনিষ্কাশন, কৃষিজল ও তেল ছড়িয়ে পড়ে এর আরো অবনতি হয়েছে।
অধিকন্তু দজলা ও ফুরাত থেকে উৎপন্ন হওয়া শাত আল-আরব নদীতে উপসাগর থেকে আসা লবণাক্ত পানি নদীর উজানে ধীরে ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে, যার ফলে বসরা অঞ্চলে লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উজানে বাঁধের কারণে মিঠা পানির প্রবাহও হ্রাস পাচ্ছে।
আবুল খাসিব জেলার ‘মিহায়লা ডিস্যালিনেশন স্টেশনটি’ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বসরার পানি সংকট নিরসনে কাজ করছে। এটি নদীটির উচ্চ পরিমাণে লবণযুক্ত পানি শোধনের জন্য একটি বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে।
মিহায়লা ডিস্যালিনেশন স্টেশনের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার সা’দুন আব্বুদ বলেন, আমরা প্রতিদিন প্রায় ৭২,০০০ ঘনমিটার [১৯ মিলিয়ন গ্যালন] পরিশোধিত পানি উৎপাদন করি, যা আবুল খাসিব জেলার শুধুমাত্র ৫০ শতাংশ পানির জোগান দেয়।
তিনি আরো বলেন, শাত আল-আরব নদীর লবণাক্ততা প্রায় ৪০,০০০ দ্রবীভূত কঠিন পদার্থে পৌঁছেছে।
বিশেষজ্ঞগণ এব্যাপারে সতর্ক করে বলেন, সরকার জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ না নিলে পানির সংকট আরো খারাপের দিকে যাবে।
পানি বিশেষজ্ঞ আলা আল-বদরানি বলেন,
“বসরায় লোনা জলের অনুপ্রবেশের কারণে ইতিমধ্যে ২৬-৩০টি বৈচিত্র্যময় সামুদ্রিক প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটেছে। এটি একটি নতুন হাইব্রিড পরিবেশ তৈরি করেছে যা মিঠা পানি এবং সমুদ্রের উভয় প্রজাতির জন্যই অনুপযুক্ত। লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই পানি কৃষিকাজের জন্যও অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে।
চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা প্রোগ্রামের রিসার্চ ফেলো হায়দার আল-শাকেরি ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ওয়েবসাইট’ এর জন্য লেখা একটি আর্টিকেলে লিখেছেন, “যদিও বৃষ্টিপাত হ্রাস এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি পুরো পৃথিবীর জন্যই একটি চ্যালেঞ্জ, কিন্তু ইরাকের পানি সংকট হলো উজানের বিধিনিষেধ এবং অভ্যন্তরীণ অবহেলার ফলাফল।”
তিনি আরো বলেন, “ইরাকের রাজনৈতিক অভিজাতদের দুর্নীতি ও স্বার্থপরতা দেশটির প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এর ফলে প্রতিবেশী দেশ তুরস্ক ও ইরানের জন্য এমন চুক্তি করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যা ইরাকের জন্য অগত্যা লাভজনক নয়।”
ইরাকের পানি সংকট সমাধানের জন্য অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক উভয় স্তরেই সংস্কার প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ইরাকের উচিত স্থানীয়ভাবে একটি জাতীয় পানি কূটনীতি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা। আলোচনা, পানির প্রবাহ পর্যবেক্ষণ, মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার এবং কুর্দি অঞ্চলের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার জন্য যার স্পষ্ট ম্যান্ডেট থাকবে।”
সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে ইরাকের পানি দূষণের মাত্রা সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছিলো। ১১৮ জনেরও বেশি লোকের মাঝে এর লক্ষণ দেখা দিয়েছিলো, যার কারণে তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিলো। এখন আবারও প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।






