কাবুল এক নতুন ইতিহাস রচনা করল। একসময় যুদ্ধের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন এই শহর এবার বিদ্যুতের আলোয় সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আফগানিস্তান ব্রেশনা কোম্পানির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হলো বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণ ও সহায়তা সম্মেলন। এতে অংশ নেন বিশ্বের ২২টি দেশের বিনিয়োগকারী, বিশেষজ্ঞ ও অর্থনৈতিক স্থপতিরা। আয়োজকদের মতে, এটি কেবল একটি অর্থনৈতিক সমাবেশ নয়, বরং তালেবানের নেতৃত্বের হাত ধরে আফগানিস্তানের অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রার সূচনা।
ব্রেশনা কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ড. আবদুল বারী ওমর জানান, এই সম্মেলনে প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরির জন্য বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ১৮টি সমঝোতা ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, সৌর, গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন, সাবস্টেশন ও গ্রিড সম্প্রসারণ, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম উৎপাদন এবং ব্যাংকিং খাতে আর্থিক সহায়তা।
তিনি আরও জানান, চলতি বছরেই নেটওয়ার্ক সংস্কার ও মেরামতের জন্য ১৬৫ মিলিয়ন আফগানির সরঞ্জাম কেনা হয়েছে এবং নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও নতুন সরঞ্জামের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬ বিলিয়ন আফগানি।
ড. ওমর বলেন, “বিদ্যুৎ শুধু বাতির আলো নয়; এটি সভ্যতার রক্তধারা, শিল্পের প্রাণশক্তি এবং জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতীক। আফগানিস্তান প্রবহমান নদী, সূর্যের আলো ও বাতাসের দেশ হলেও এগুলো তখনই জাতির আশার আলোতে রূপ নেবে, যখন একটি মর্যাদাবান শাসনব্যবস্থা তা জনগণের কল্যাণে কাজে লাগাবে।”
তিনি বলেন, আফগানিস্তান শক্তির বিশাল উৎসের দেশ। পানি, সূর্য, বায়ু, বায়োমাস ও ভূ-তাপীয় খাত থেকে হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।
ড. ওমর আরও বলেন, “আজ ক্ষমতার দ্বীপপুঞ্জ ও প্রভাবশালীদের প্রভাব শেষ হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বচ্ছতা। ফলে বিনিয়োগের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আফগানিস্তান জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নয়, কিন্তু এর ক্ষতি ভোগ করছে। তাই বৈশ্বিক সহযোগিতা অপরিহার্য। মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ সহজীকরণও আমাদের লক্ষ্য।”
তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উদ্দেশে আহ্বান জানান, “বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক অংশীদাররা অসমাপ্ত প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করুক। আফগানদের অধিকার রয়েছে এসব প্রকল্প সম্পূর্ণ হওয়ার।”
ড. ওমর আরও যোগ করেন, “উন্নয়নের বার্তা প্রতিদিন ছড়িয়ে পড়ছে, স্বচ্ছতা এসেছে, আর আমাদের সরকার দেশের পুনর্গঠনে অঙ্গীকারবদ্ধ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক প্রতিটি খাতেই বিদ্যুৎ অপরিহার্য—তাই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন।”
আফগান ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী মোল্লা বারাদার আখুন্দ বলেন, “আফগানিস্তানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। সেগুলো কাজে লাগাতে পারলে দেশ শুধু আত্মনির্ভরশীল হবে না, বরং বিদ্যুৎ রপ্তানিকারক রাষ্ট্রে পরিণত হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আজকের সম্মেলন বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় সুযোগ। আশা করি সবাই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবেন।” একইসঙ্গে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান তিনি।
ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী মাওলানা আবদুস সালাম হানাফী বলেন, “প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ধর্মীয়, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক মিল রয়েছে। পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্মানের ভিত্তিতে সম্পর্ক আরও মজবুত করতে হবে।”
তিনি আরও জানান, আফগানিস্তানে পাঁচটি গ্যাস ব্লক ও কয়লার ভান্ডার রয়েছে, যা দুই শতাব্দী পর্যন্ত ব্যবহার করা সম্ভব। পাশাপাশি সৌর ও বায়ুশক্তিসহ নবায়নযোগ্য শক্তিরও বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাওলানা আমীর খান মুত্তাকী বলেন, “পূর্বাঞ্চলে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় এগিয়ে এসে আফগানরা প্রমাণ করেছে তারা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি। আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও দেখিয়েছে, বিশ্ব আমাদের দুঃখে পাশে আছে।”
আফগান দপ্তর বিষয়ক মহাপরিচালক মাওলানা নুরুল হক আনোয়ার বলেন, “বিশ্ব এখন বুঝছে, অস্থিতিশীলতার দ্বীপপুঞ্জ বিলীন হয়েছে; বিনিয়োগের সব সুযোগ তৈরি। আইন–নীতিমালা অনুমোদন ও অঞ্চলভিত্তিক জমি বরাদ্দসহ বহু সুবিধা দেওয়া হয়েছে।”
সম্মেলনে অংশ নেওয়া তাজিকিস্তান বিদ্যুৎ কোম্পানির প্রধান মোহাম্মদ ওমর আসোজাদা বলেন, “ব্রেশনা কোম্পানির এই বড় সম্মেলন একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ; ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আমরা এর প্রশংসা করি এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতা আরও জোরদার করব। কাসা–১০০০ প্রকল্পেও আমাদের অংশীদারিত্ব অব্যাহত থাকবে।”
তুর্কমেনিস্তানের জ্বালানি মন্ত্রী আনাগেলদি সাপারভ বলেন, “বিদ্যুৎ খাতে আফগানিস্তানের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, যেমন নুর–আল–জিহাদ সাবস্টেশনে ২২০ কেভি লাইনসহ একাধিক প্রকল্প।”
তুর্কি মারবাইনস কোম্পানির প্রধান গুনাই কোসা বলেন, “আমরা ছোট ও বড় উভয় পরিসরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ করতে পারি; আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে উন্নয়নমূলক কাজেও অংশ নিতে চাই।”
আজিজি গ্রুপের প্রতিনিধি আমির খান ইয়ার বলেন, “বিদ্যুৎ উৎপাদনে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করছি; কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও কাজ করব।”
তুর্কি ৭৭ কোম্পানির প্রতিনিধি আসাদুল্লাহ হামদার্দ ব্রেশনা নেতৃত্বের উষ্ণ আতিথেয়তার প্রশংসা করেন।
গজনফর গ্রুপের প্রধান মোহাম্মদ ইসমাইল গজনফর বলেন, “ছোট থেকে বড় যে কোনো পরিসরে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করুন, দেশগঠনের সূচনা বিদ্যুৎ থেকেই।”
বিনিয়োগ সমন্বয় পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার ফারিদুল্লাহ শরাফমল বলেন, “আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদাররা প্রকল্প বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতকে সহায়তা করতে পারেন।”
চেম্বার অব কমার্সের ডেপুটি চেয়ারম্যান আরিয়ান আজমি বলেন, “ব্রেশনার উদ্যোগে বিনিয়োগ বাড়ায় দেশে ৬ হাজারের বেশি কারখানা কার্যক্রম সম্প্রসারণ করছে। এখন নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত—তাই সবাইকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগের আহ্বান জানাই।”